
দেশের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় তুচ্ছ ঘটনার জেরে সহিংসতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে জেলাজুড়ে অন্তত ৩০০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। যেখানে আহত হয়েছেন সহস্রাধিক মানুষ এবং নিহত হয়েছেন ৬ জন। সংঘর্ষ থেকে রেহাই পাননি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এবং পুলিশ সদস্যরাও।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই সংঘর্ষগুলোর মূল কারণ হলো গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব। জেলার ৯টি উপজেলার ৫টি পৌরসভা এবং ১০০ ইউনিয়নের প্রায় ১ হাজার ৪০০ গ্রামের বেশিরভাগ স্থানে শক্তিশালী গোষ্ঠীগত ঐক্য বিদ্যমান। অনেক সময় এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর জোটও তৈরি হয়। নিজ নিজ গোষ্ঠী বা এলাকার সম্মান রক্ষায় কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি হয় না।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি নিজেদের প্রভাব টিকিয়ে রাখতে কখনো কখনো এই ঝগড়াগুলোকে উসকে দেন! এছাড়া, প্রবাসীরাও এই বিষয়গুলোকে নিজেদের ‘ইজ্জত রক্ষার লড়াই’ হিসেবে দেখে অর্থ ব্যয় করেন, যা সংঘর্ষের তীব্রতাকে বাড়িয়ে তোলে।
সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত দেশীয় অস্ত্র, যেমন—দা, লাঠি, বল্লম ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকে। নিজেদের সুরক্ষায় সংঘর্ষপ্রবণ এলাকার বেশিরভাগ বাড়িতেই দেশীয় অস্ত্র মজুত থাকে এবং সংঘর্ষের সময় অংশগ্রহণকারীরা মাথায় হেলমেট পরে থাকে। উদ্বেগজনকভাবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা করা হয় না।
শসা খাওয়া থেকে টিস্যু চাওয়া: সংঘর্ষের সূত্রপাত তুচ্ছ ঘটনায়
সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ সংঘর্ষের সূত্রপাত অত্যন্ত তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে।
- শসা নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘাত (নাসিরনগর): গত ১০ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার বুড়িশ্বর ইউনিয়নের শ্রীঘর গ্রামে এক কিশোর বাড়ির পাশের জমি থেকে মালিককে না জানিয়ে শসা খায়। এর জেরে কিশোর হৃদয়ের চাচা জমির মালিকের কাছে ক্ষমা চাইতে গেলে হৃদয়ের গোষ্ঠী এটিকে নিজেদের সম্মানহানি মনে করে ক্ষুব্ধ হয়। রাতভর উত্তেজনা চলার পর ভোর থেকে দুই পক্ষ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হন।
- টিস্যু বিভ্রাট থেকে সংঘর্ষ (সরাইল): একই দিনে, অর্থাৎ ১০ জুন রাতে জেলার সরাইল উপজেলায় একটি হোটেলে টিস্যু চাওয়াকে কেন্দ্র করে কুট্টাপাড়া ও পাঠানপাড়ার লোকজনের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। এই ঘটনায় অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন।
- জমির বিরোধে কব্জি বিচ্ছিন্ন (বিজয়নগর ও নবীনগর): গত ২২ জুন বিজয়নগর উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের চানপুরে রেলওয়ের জায়গা নিয়ে দুই পক্ষের বিরোধের জেরে মো. ইদ্রিস মোল্লা (৬৫) নামের এক বৃদ্ধের বাঁ হাতের কব্জি কেটে ফেলা হয়। এর মাত্র চার দিন পর ২৬ জুন নবীনগর উপজেলার নাটঘর ইউনিয়নের চড়িলাম গ্রামে রফিকুল ইসলাম (৫০) নামের এক ব্যক্তির কব্জি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয় পারিবারিক জমি বিরোধের জের ধরে।
- ফুল ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে পুলিশের ওপর হামলা (আশুগঞ্জ): গত ২২ জুন আশুগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ ও কবরস্থান থেকে ফুল ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে মহাজনবাড়ি ও জাকেরবাড়ির লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে সাতজন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন।
- রান্নার ধোঁয়ায় হত্যাকাণ্ড (সদর): গত ১৬ জুন সদর উপজেলার সুলতানপুর ইউনিয়নের উড়শিউড়ায় রান্নার চুলার ধোঁয়া ঘরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে পারিবারিক সংঘর্ষে মনির হোসেন নামের এক ব্যক্তি খুন হন।
এদিকে নিয়মিত সংঘর্ষ কমাতে সরাইল উপজেলা প্রশাসন প্রতিটি ইউনিয়নে সচেতনতামূলক সমাবেশ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
সরাইল সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল জব্বার বলেন, “এক গোষ্ঠীর লোকজনকে আরেক গোষ্ঠীর লোক মেরে দিলে এটা সহ্য হয় না। এ বিষয়ে কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না। সে কারণে আমাদের এলাকায় ঝগড়া-ফ্যাসাদ লেগেই থাকে।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. বাহারুল ইসলাম মোল্লা এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “অনেক সময় দেখা যায়, জেলার অনেক সাফল্য ঝগড়ার খবরে ঢাকা পড়ে যায়। কারণে-অকারণে ঝগড়ার এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব