বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু বায়ুদূষণের কারণে ২ বছর ৪ মাস কমছে। তবে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস।
মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) আয়োজিত বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বাংলাদেশ সংগঠনটির যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত বায়ু দূষণ বিষয়ক বৈশ্বিক প্রতিবেদন ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ এ এসব তথ্য উঠেছে বলে জানায় বাপা।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দা চেস্ট অ্যান্ড হসপিটাল ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৭ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫ হাজার।
তিনি জানান, রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। এবারের (২০২৩) জুলাইয়ে সে সংখ্যা ১৪ হাজার পার হয়েছে।
বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা, দূষণ বাংলাদেশে মানবস্বাস্থ্যের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলে জানিয়েছে কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স- ২০২৩। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সীসা দূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন ১ লাখ ৩৮ হাজারও বেশি মানুষ। একই কারণে শিশুদের আইকিউ কমে যাচ্ছে এবং ফলে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
বায়ুদূষণের কারণ উল্লেখ করে তিনি জানান, বায়ুদূষণের কারণগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াজনিত কারণ, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব অন্যতম। রাস্তা খোঁড়াখুড়ি ও নির্মাণ কাজ থেকে ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, আন্তদেশীয় বায়ুদূষণ থেকে ৬.৫ শতাংশ, গৃহস্থালী বা রান্নার চুলার কাজের থেকে ৮.৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে।
স্থপতি ইকবাল হাবিব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বায়ুদূষণের কারণে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ নাগরিক শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এটা সারা দেশের ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করছে। সরকারকে স্পষ্ট করতে হবে, বিকলাঙ্গ প্রজন্ম, প্রতিবন্ধী শিশু তৈরি করবেন নাকি শিল্পপতিদের কাছে মাথানত করেন। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এই ব্যাপারে সরকারকে অঙ্গীকার করতে হবে।
বায়ুমান উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ, মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। পদক্ষেপগুলো হলো—
স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপগুলো হলো:
১. নির্মাণকাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে।
২. শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদফতরের সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলোতে প্রতি ২-৩ ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
২. রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে।
৪. বাক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বেজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।
মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপগুলো হলো:
১. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদ বাগান করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে। দূষিত শহরগুলোর আশেপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।
২. আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসাবে সেন্ড বক্লের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।
৪. সিটি গভর্নেন্স এর প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপগুলো হলো:
১. নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যতদ্রুত সম্ভব প্রণয়ন করতে হবে।
২. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশনের (ক্যামস) ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়াও বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে।
৩. পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে।
৪. সর্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ু দূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্য নির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ু দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।