প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আজ সংসদে বলেছেন, জনগণ থেকে কেউ তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবেন না। আমার একটাই শক্তি হচ্ছে-জনগণ। তাদের শক্তি নিয়েই আমি চলি। জনগণের মধ্যে একটি আস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, আমি তাদের জন্য কাজ করি। কাজেই এই আস্থা ও বিশ্বাসটাই হচ্ছে আমার একমাত্র সম্বল। আর এই সম্বল নিয়েই আমি চলি। এ জন্যই আমি কাউকে পরোয়া করি না।’
তিনি দৃঢ় কন্ঠে বলেন, ‘যতক্ষণ আমার দেশবাসী আমার পাশে আছে ততক্ষণ আমি কাউকে পরোয়া করি না।’
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা আজ আজ দ্বাদশ জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় অধিবেশনের সমাপণী ভাষণে এ কথা বলেন। এ সময় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী অধিবেশনে সভাপত্বি করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করি। যে কাজগুলো আমরা করেছি তার সুফলটা দেশবাসী পাচ্ছে, সেটাকে স্বীকার করেন। কিন্তু প্রত্যেকটা কাজকে যদি প্রশ্নবিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে (চেষ্টা) করা হয়, হ্যাঁ তাতে কি করতে পারেন, জনগণের কাছ থেকে তো আমাকে দূরে সরাতে পারবেন না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হ্যাঁ আমি জানি, আমার বাবার সঙ্গেও একই জিনিস হয়েছে। যতগুলো কাজ তিনি করে গেছেন মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে- সংবিধান দেওয়া থেকে শুরু করে এমন কোন সেক্টর নাই যার ভিত্তিটা তিনি তৈরি করে দেন নাই। তারপরও তাঁর সমালোচনা, তার বিরুদ্ধে নানা কথা লেখা, অনেক কিছু করে তাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। যখন পারেনি তখন তাকে হত্যা করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাকেও হত্যার জন্য বার বার চেষ্টাই করা হয়েছে। কিন্তু আমি বেঁচে গেছি সেটাও আমার জনগণ এবং দলের নেতাকর্মীরা সব সময় আমাকে ঘিরে রেখেছে। নিজেরা জীবন দিয়ে আমার জীবন বাঁচিয়েছে। আমি এখন জনগণের জন্যই কাজ করে যেতে চাচ্ছি এবং কাজ করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার বিগত ১৫ বছরে যে পরিমাণ কাজ করেছে অন্যরা ২৯ বছরেও সে কাজ করতে পারে নাই। পারবেনও না কারণ প্রকল্প দিয়েইতো আগে টাকা খাওয়া। আর আমরা প্রকল্প শেষ করেই ছাড়ি, টাকা খাওয়ার কোন সুযোগ নাই। এটা হলো বাস্তবতা।
এ সময় পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরুতে ভুয়া দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থ প্রত্যাহার করে নেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, তাদের অভিযোগের বিরুদ্ধে তিনি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন যে, এখানে কোন দুর্নীতি হয়নি এবং বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি।
তিনি এ সময় দেশে বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নে অন্য দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত অধিক অর্থ ব্যয় সংক্রান্ত বিরোধী দলীয় নেতার বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, আমাদের এটা ব-দ্বীপ। এখানকার ভূমি নরম থাকায় যে কোন অবকাঠামোগত প্রকল্প গ্রহণে অধিক অর্থ ব্যয় হয়।
কিছু জিনিষ যে আপনারা তৈরী করে (অতীতের রেখে গেছেন). সেই জিয়াউর রহমানের আমল থেকে একটি কালচার তৈরী করে রেখে গেছেন, সেটাতো একটু আছে, সেখান থেকে আমরা উত্তরনের চেষ্টা করছি, বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেউ কেউ মেট্রোরেল নিয়েও প্রশ্ন তোলেন? এর কী প্রয়োজন ছিল। তিন হাজার কোটি টাকা দিয়েইতো যানজটমুক্ত হতো। আজকে প্রতি ঘন্টায় ৬০ হাজার মানুষ মেট্রোরেল দিয়ে চলতে পারে, ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষ চলাচল করতে পারবে দিনে। উত্তরা থেকে সেই বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। এরপর এটা কমলাপুর রেল ষ্টেশন পর্যন্ত যাবে। এটায় যারা চড়ছে তারা সুফল পাচ্ছে। যারা এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল- তারা লজ্জা পাচ্ছে কী না জানিনা। কেউ কেউ আবার পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যদিও এখান থেকে সব থেকে ভাল বিদ্যুৎ আমরা পাব। এজন্য সেখানে আমরা আরো একটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করবো।
বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, যতই বলেন, যেখানে ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ছিল, আজকেতো ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ আমরা উৎপাদন করতে পারি।
তিনি বলেন, যে কাজগুলো আমরা করেছি তার সুফলটা দেশবাসী পাচ্ছেন। সেটাকে স্বীকার করেন।
সরকারের সমালোচকদের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা আরও বলেন, মানুষের কল্যাণে কী করণীয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা কাজ করি। দেশের কল্যাণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ভোগ করবেন সবাই আর কথায় কথায় ব্যাঙ্গো করবেন আর প্রশ্ন তুলবেন। প্রশ্ন তোলার আগে- নিজেরা কী করেছেন? কোন দল করেন- সেই দলের বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে অপকর্মগুলো একটু চিন্তা করে নেবেন। আয়নায় নিজেদের চেহারাটা আগে দেখেন।
তিনি বলেন, তাঁর সরকার রুপকল্প-২০২১ ঘোষণা করেছিল সেটা কোভিড-১৯সহ নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে আজকে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছে।
অতিমারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং স্যাংশন ও পাল্টা স্যাংশনে বিশ্ব মন্দা ছোঁয়ায় দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাধারণ বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষদের কিছুটা কষ্ট হচ্ছে সেক্ষেত্রে তাঁর সরকার প্রায় এক কোটি মানুষকে পারিবারিক কার্ডের মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য স্বল্পমূল্যে সরবরাহ করার ব্যবস্থা নিয়েছে।
প্রতিটি ক্ষেত্রে ভর্তুকি প্রদান করে সাধারণের জীবনযাপন সহজ করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই, বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান, ভূমিহীনদের বিনামূল্যে ঘর এবং জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দেওয়াসহ সরকার গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত কর্মসংস্থান বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে ২১টি জেলা এবং ৩৩৪টি উপজেলা ভূমিহীন-গৃহহীন মুক্ত বলে তাঁর সরকার ঘোষণা দিয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সরকার প্রধান বলেন, তাঁর সরকারের বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপের ফলে অতি দরিদ্রের হার আজকে কমে ২৫ দশমিক ১ ভাগ থেকে ৫ দশমিক ৬ ভাগে এসেছে।
তিনি বলেন, ইনশাল্লাহ এদেশে কোন অতিদরিদ্র বলে কেউ থাকবে না। ইতোমধ্যে দারিদ্রের হার ৪১ ভাগের ওপর থেকে নেশে ১৮ দশমিক ৭ ভাগে এসেছে। কোভিড-১৯, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, স্যাংসন ইত্যাদির কারণে মূল্যস্ফীতি না হলে এটা তাঁর সরকার আরও কমিয়ে ফেলতে পারতো। তারপরও সরকারের লক্ষ্য রয়েছে ভবিষ্যতে এটা কমিয়ে ফেলার।
তিনি এ সময় দেশের প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে সার্বিক উৎপাদন বাড়িয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার ওপরও পুনরায় গুরুত্বারোপ করেন।
কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সমালোচনার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশেষ আইনে কাউকে কিন্তু দায় মুক্তি দেওয়া হয়নি। বরং বেসরকারি খাতে প্রথম বিদ্যুৎ কেন্দ্র করেছিল সামিট গ্রুপ খুলনায়। তারা ঐ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্পন্ন করতে দেরি করেছিল, যে কয়দিন দেরি করেছিল প্রতিদিন ১০ হাজার ডলার করে তাদের জরিমানা দিতে হয়েছে। আর সেই জরিমানা আমি আদায় করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, দায়মুক্তি আমরা দেই না এটা মাথায় রাখতে হবে।
এ সময় জিয়াউর রহমানের সময় থেকে দেশে চালু হওয়া প্রহসনের নির্বাচন, পরবর্তীতে এরশাদ এবং খালেদা জিয়ারও তা অব্যাহত রাখার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া ’৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন করে এবং পরবর্তীতে পদত্যাগে বাধ্য হয়।
২০০১ সালে বিদেশিদের কাছে দেশের গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেই বিএনপি-জামায়াত কর্তৃক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, দুর্নীতিতে দেশকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করা এবং দেশে ইমার্জেন্সি নিয়ে আসা, ১ কোটি ২৩ লাখ ভূয়া ভোটার তৈরি করে নির্বাচনে জয়লাভের চেষ্টা, আগুন সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ ও বাংলা ভাই সৃষ্টি এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেখানে এককভাবে ২৩৩টি আসন পেয়েছে সেখানে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মাত্র ৩০ আসনে জয়লাভ করে এবং এরপর থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনীহাসহ দেশের গণতন্ত্র নিয়ে বিএনপি’র নেতৃবৃন্দের ঢালাও সমালোচনার কঠোর জবাব দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, আজকে অনেকে গণতন্ত্রের কথা বলে। গণতন্ত্রের প্রবক্তা হয়ে গেছে কেউ কেউ। আমার প্রশ্ন যারা এখন গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চিৎকার করছে তাদের জন্মটা কি গণতন্ত্রের মধ্যদিয়ে হয়েছে? না ঐ রক্তাক্ত হাতে যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল সেই সেনা কর্মকর্তার পকেট থেকে বের হওয়া রাজনৈতিক দল তারা? যারা বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিল।
প্রধানমন্ত্রীর আগে বক্তব্য দেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।