জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে “আদিবাসী” শব্দযুক্ত গ্রাফিতি বাদ দিয়ে নিজেকে পতিত কর্তৃত্ববাদের দোসর ও পুনর্বাসনকেন্দ্র হিসেবে পরিচয় দিয়েছে উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
এনসিটিবির এ সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী সময়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদরত সংক্ষুব্ধ আদিবাসীদের ওপর ধারাবাহিক হামলাকে রক্তস্নাত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে সূচিত বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ -এর চেতনা ও প্রত্যাশার সঙ্গে প্রতারণা উল্লেখ করে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এনসিটিবির জবাবদিহিতাসহ এই প্রতিষ্ঠানটিকে কর্তৃত্ববাদের দোসরমুক্ত করে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত গতকালের প্রেস বিজ্ঞপ্তিকে সময়োপযোগী উল্লেখ করে বাংলাদেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আদিবাসী হিসেবে আত্মপরিচয়ের স্বীকৃতিসহ সমঅধিকারভিত্তিক মর্যাদার প্রশ্নে সরকারের অবস্থান সুস্পষ্ট করারও আহ্বান জানিয়েছে টিআইবি।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হুমকির প্রেক্ষিতে পাঠ্যবইয়ের পেছনের প্রচ্ছদে থাকা আদিবাসীসহ সকল বৈচিত্র্যের মানুষের সমঅধিকারের প্রতিফলনমূলক গ্রাফিতি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরিয়ে দিয়েছে এনসিটিবি।
এনসিটিবির এ পদক্ষেপকে কর্তৃত্ববাদের এজেন্ডা বহাল রাখার ঘৃণ্য প্রয়াস উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এনসিটিবি প্রমাণ করতে চেয়েছে, বাংলাদেশে গত ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদের পতন হলেও এই সংস্থায় কর্তৃত্ববাদের চর্চার পরিবর্তন হয়নি। বরং যৌক্তিক প্রশ্ন উঠেছে এনসিটিবি কি বাস্তবে পতিত কর্তৃত্ববাদের এজেন্ডা বহাল রাখার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে?’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরো বলেন, ‘এনসিটিবি এবং যারা আদিবাসী হিসেবে আদিবাসীদের নিজেদেরকে পরিচিত থাকার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা ও দাবির বিরোধিতা করছেন, এবং বিশেষ করে সরকারের অজানা থাকার কথা নয়, বাংলাদেশে “আদিবাসী” পরিচয় ব্যবহার করা যাবে না-এমন উদ্ভট তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলো কর্তৃত্ববাদী সরকার। আর তার পেছনে ইন্ধন ছিলো এমন স্বার্থান্বেষী মহলের যারা আদিবাসী অধিকার হরণের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে মিথ্যাচারের মাধ্যমে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীকে বলতে চেয়েছিলো- “বাংলাদেশে আদিবাসী নেই।” তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্বীকার করতে চায়নি যে আদিবাসী পরিচয়ের মানদণ্ড কোনো জনগোষ্ঠী কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে কতকাল যাবত বসবাস করছেন তার উপর নির্ভর করে না। তারা মানতে চায়নি যে আদিবাসী হচ্ছেন মূলধারার সংখ্যাগরিষ্ঠের বাইরে এমন জনগোষ্ঠী যারা তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রথাগত ও প্রাকৃতিক পরিবেশ-নির্ভর জীবনাচরণের ধারা বহাল রেখে নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচিত থাকতে চায়। আদিবাসী পরিচয়ের উক্ত ব্যাখ্যা যে বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত তা না জানা এনসিটিবি’র জন্য লজ্জাজনক। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট অংশীজন ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে কোনো প্রকার বিচার বিবেচনা না করে এক পক্ষের আব্দারের দোসর হওয়া পতিত কর্তৃত্ববাদী সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের প্রতিফলন ছাড়া আর কিছুই না। একইসঙ্গে তা নজিরবিহীন রক্তপাত ও প্রাণহানির বিনিময়ে অর্জিত অন্তর্ভুক্তিমূলক বৈষম্যমুক্ত “নতুন বাংলাদেশ”-এর আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে শুধু সাংঘর্ষিকই নয়, প্রতারণাও বটে।’
ড. জামান বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশিত গতকালের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ অবস্থান স্পষ্টভাবে পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে যে বাংলাদেশে সহিংসতা, জাতিগত বিদ্বেষ এবং ধর্মান্ধতার কোনো স্থান নেই। যারা ঐক্য, শান্তি ও আইনশৃঙ্খলার বিনষ্ট করবে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না বলে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। আমরা সরকারের এ বার্তাকে সময়োপযোগী হিসেবে স্বাগত জানাই। তবে উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি যে এতে দৃশ্যত সচেতন ভাবে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পরিচয় হিসেবে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। যা জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত প্রধান উপদেষ্টার ২৫ আগস্টের ২০২৪’র ভাষণে আদিবাসী পরিচয় বিষয়ক শব্দচয়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যদি এটি সচেতন ভাবেই ঘটে থাকে, তাহলে কি এর মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী এজেন্ডা ও বয়ানের প্রতিফলন ঘটেছে বলে ধরে নিতে হবে না? ‘আদিবাসী’ পরিচয়ের বস্তুনিষ্ঠ ব্যখ্যা ও এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক চর্চার অনুসরণে অবস্থান নির্ধারণের জন্য আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আদিবাসী পরিচয় ব্যবহারের বিরোধী অন্য সকল অংশীজনদের প্রতিও আমাদের একই আহ্বান। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন শুধু ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের মাধ্যমে সম্ভব নয়, কর্তৃত্ববাদ চেতনা ও এজেন্ডা এবং তার বলপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার চর্চার আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য।’