একটা সময় কুমিল্লার খাল-বিল, পুকুর-জলাশয়ে বরশি কিংবা জাল টান দিলেই কেজি কেজি পাওয়া যেতো বিভিন্ন প্রজাতির পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ সুস্বাদু ছোট ছোট মাছ। তবে এখন এই মাছ গুলো পাওয়া যাচ্ছেনা বললেই চলে। বিলুপ্তির পথে প্রায় এই দেশীয় প্রজাতির মাছ।
কুমিল্লার মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাছের প্রাকৃতিক আবাসভূমি এতটাই দ্রুত বদলে যাচ্ছে যে, টিকে থাকার উপযোগী জায়গা সংকীর্ণ হতে হতে কোথাও প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণেই অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়েছে এবং বিলুপ্তির পথেও রয়েছে।
তাদের তথ্যমতে, প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—জলাভূমি বা প্লাবনভূমির সঙ্গে সংযোগ খাল ভরাট, জলাশয়ে বছরের অধিকাংশ সময় পানি না থাকা এবং প্রজনন মৌসুমে পানিপ্রবাহ কমে যাওয়া। এছাড়া মনুষ্যসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—জমিতে রাসায়নিক সার ও অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার, মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করা এবং ক্ষতিকর মৎস্য আহরণ সরঞ্জামের ব্যবহার।
মৎস্য বিভাগ ও মৎস্যচাষি সূত্রে তথ্য জানা গেছে, প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস হওয়া এবং ছোট মাছ সংরক্ষণে সরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ে উদ্যোগ না থাকায় ছোট প্রজাতির মাছ ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। আবার পুকুরে বড় মাছ চাষের আগে ছোট মাছ বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া ব্যবসায়িকভাবে লাভজনক না হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ মাছের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছেন।
জানা গেছে, এক সময় দেশি জাতের ছোট মাছের উৎস ছিল হাওর, বাঁওড়, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় ও বিভিন্ন নদী-নালা। কিন্তু দিনে দিনে কমছে নদী-নালা-জলাশয়, যা আছে তার বেশির ভাগেই বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষ হয়। উন্মুক্ত জলাশয়ে বিনা বাধায় মাছ শিকারের সুযোগ আর তেমন মেলে না। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা এসব মাছের অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম রয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে— চ্যাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, নাপতানি, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, বাইলা, মেনি, ভেদা, শিং, কৈ, টাকি, তেলা টাকি, ফলি, চেলি, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনা, বাচা, বাটা, রিটা, পিয়ালি, জয়া, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, চান্দা, কাজলিসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির মাছ।
কুমিল্লার দাউদকান্দি, হোমনা, তিতাস, মেঘনা, চান্দিনা, মুরাদনগর উপজেলা এলাকার বিভিন্ন জলাশয় ছাড়াও গোমতী, তিতাস, ডাকাতিয়া ও সালদা নদী থেকে বাজারে এক যুগ আগেও প্রতিদিন কুমিল্লা নগরীর রাজগঞ্জ, চকবাজার, বাদশামিয়া বাজার, রানীর বাজার, টমছমব্রিজ ও পদুয়ার বাজারসহ ছোট-বড় বিভিন্ন বাজারে দেশীয় প্রজাতির পর্যাপ্ত ছোট মাছ আসত। চাহিদা সত্ত্বেও ক্রেতারা এখন এ জাতীয় মাছের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে কুমিল্লার চান্দিনার কলেজ শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, কোনো রকমের চাষ ছাড়াই এ এলাকার নিচু জমি ও খালে-বিলে একসময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। বাজারগুলোও ভরে যেত দেশীয় মাছে। এখন জমিতে কীটনাশকের ব্যবহারের কারণে মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত কুমিল্লার মৎস্যচাষি মো. শাহ আলম জানান, চাহিদা থাকলেও ছোট প্রজাতির মাছের সরবরাহ অনেক হ্রাস পেয়েছে। উত্পাদন কমে যাওয়ায় ছোট মাছের চালান কমে গেছে।
এ বিষয়ে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. রেজাউল করিম গণমাধ্যমকে বলেন, প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছের উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে পুষ্টিগুণসম্পন্ন মাছ বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্যও উদ্বেগজনক। আকারে ছোট হলেও এসব দেশীয় মাছ পুষ্টিগুণে সেরা।
এ বিষয়ে কুমিল্লা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ না ধরে প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ করতে হয়। বর্তমানে বিদেশি প্রজাতির কিছু মাছ স্বল্প সময়ে বৃদ্ধি ও লাভজনক হওয়ায় অনেক মৎস্যচাষি এদিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
তবে জলাশয়গুলোতে ডিমওয়ালা মাছ অবমুক্তকরণ, ছোট মাছের উপকারিতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণ, জেলে পরিবারগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ে মাছ ধরার পরিবর্তে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সমন্বিত বালাইনাশক প্রয়োগপদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও কীটনাশকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির মাছ রক্ষা করা সম্ভব। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি।