বুধবার ৮ অক্টোবর, ২০২৫

হৃদয়ের ক্যানভাসে প্রকৃতির রঙ: ঋতুভেদে আমাদের অনুভূতির সফর

ওসমান গনি, চান্দিনা প্রতিনিধি

হৃদয়ের ক্যানভাসে প্রকৃতির রঙ: ঋতুভেদে আমাদের অনুভূতির সফর
হৃদয়ের ক্যানভাসে প্রকৃতির রঙ: ঋতুভেদে আমাদের অনুভূতির সফর/ছবি: প্রতিনিধি

প্রকৃতি এক বিস্ময়কর শিল্পী। তিনি প্রতিমুহূর্তে তাঁর লীলাখেলায় মত্ত, আর তাঁর সেই লীলাক্ষেত্র হলো আমাদের এই পৃথিবী। ঋতুচক্রের আবর্তনে প্রকৃতি তার রূপে, রসে ও গন্ধে পরিবর্তন আনে, আর এই পরিবর্তনই তাকে বারবার সাজিয়ে তোলে অপরূপ সাজে। প্রকৃতির এই সাজ কোনো একক ঋতুর দান নয়, বরং প্রতিটি ঋতু তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসে প্রকৃতিকে নতুন জীবন দান করে।

ঋতুভেদে প্রকৃতির সাজ: গ্রীষ্মের রুদ্র রূপ: বাংলা বছর শুরু হয় গ্রীষ্ম দিয়ে। এই সময়ে প্রকৃতিতে এক কঠোর রূপ দেখা যায়। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে নদী-নালা শুকিয়ে যায়, মাটি ফেটে চৌচির হয়। এই রুক্ষতার মধ্যেও কিন্তু প্রকৃতির এক ভিন্ন সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে।

কাঠফাটা রোদের ক্লান্তি দূর করতে আসে কালবৈশাখি ঝড়, যা মুহূর্তের মধ্যে প্রকৃতিকে ধুয়ে-মুছে স্নিগ্ধ করে দেয়। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর জারুল ফুলের লালচে-বেগুনি রঙে প্রকৃতি তখন ঝলমল করে ওঠে।

বর্ষার সজীবতা: গ্রীষ্মের প্রখর তাপের পরেই আসে বর্ষা, স্নিগ্ধতা ও সজীবতার প্রতীক। আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যায়, আর অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামে। এই বৃষ্টিতে প্রকৃতি যেন নবজীবন ফিরে পায়। ধূলিমলিন গাছের পাতাগুলো আরও গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠে।

খাল-বিল, নদী-নালা জলে ভরে ওঠে, আর গ্রামের নিচু এলাকাগুলো যেন জলের বুকে ভাসমান দ্বীপে পরিণত হয়। কদম, কেয়া, ও শাপলা ফুলের মনমাতানো সুবাস বর্ষার প্রকৃতিতে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শব্দ আর ব্যাঙের ডাক প্রকৃতির এই সময়ে এক অনির্বচনীয় সংগীত সৃষ্টি করে।

শরতের শুভ্রতা: বর্ষার সজলতা কাটিয়ে প্রকৃতিতে আসে শরৎ। এই ঋতুতে আকাশ হয়ে ওঠে নির্মল নীল, আর সেই আকাশে ভেসে বেড়ায় পেঁজা তুলোর মতো সাদা মেঘের ভেলা। দিগন্ত জুড়ে কাশফুলের শুভ্রতা প্রকৃতির সাজে যোগ করে এক কোমলতা।

শান্ত আর স্নিগ্ধ এই রূপ বাঙালির মনে উৎসবের আমেজ নিয়ে আসে। সকালে শিশির ভেজা শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ জানান দেয় যে, প্রকৃতি এখন এক পবিত্রতার আবরণে আবৃত।

হেমন্তের প্রাচুর্য: শরৎ বিদায় নিলে আসে হেমন্ত—ফসল তোলার ঋতু। মাঠজুড়ে তখন পাকা ধানের সোনালি রং। হেমন্তের শান্ত, স্নিগ্ধ রূপ কৃষকের মনে আনে এক অনাবিল আনন্দ। এই সময়ে প্রকৃতি শান্ত ও স্থির থাকে, আর রাতের বেলা নেমে আসা হালকা কুয়াশা এক রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টি করে।

শীতের শান্ত রূপ: হেমন্তের পর আসে শীত। শীতের আগমন মানেই প্রকৃতিতে এক ধরনের শুষ্কতা। চারদিক ঢেকে যায় ঘন কুয়াশার চাদরে। এই সময়ে গাছপালা কিছুটা নিষ্প্রাণ মনে হলেও, শীতের প্রকৃতিও শান্ত ও নিবিড়। খেজুর রসের মিষ্টি গন্ধ, পিঠাপুলির আয়োজন আর শিশিরভেজা সবুজ ঘাস শীতের সৌন্দর্যকে ভিন্নভাবে ফুটিয়ে তোলে।

বসন্তের যৌবন: সব ঋতুর শেষে আসে বসন্ত—ঋতুরাজ। প্রকৃতি তার সমস্ত রূপ, রস ও গন্ধ ঢেলে দেয় বসন্তের আগমনে। গাছে গাছে নতুন পাতা গজায়, আর কোকিলের সুমিষ্ট কুহুতান জানান দেয় প্রাণের স্পন্দন। শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার লালে প্রকৃতি তখন ঝলমল করে ওঠে। বসন্তের দখিনা বাতাস মনকে চঞ্চল করে তোলে।

প্রকৃতির এই অপরূপ সাজ কেবল চোখকে তৃপ্তি দেয় না, বরং মন ও আত্মাকেও করে তোলে সতেজ। প্রতিটি ঋতু আসে তার নিজস্ব বার্তা নিয়ে, আর এই বার্তা হলো পরিবর্তনই জীবন। প্রকৃতির এই নিরন্তর পরিবর্তনশীল সৌন্দর্যই আমাদের জীবনে নতুন উদ্দীপনা জাগায় এবং বারবার মুগ্ধ করে। প্রকৃতির এই দানকে রক্ষা করা আমাদের সকলের কর্তব্য।

আরও পড়ুন