এপ্রিল ২৬, ২০২৫

শনিবার ২৬ এপ্রিল, ২০২৫

সুন্দরবনে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জলদস্যুরা

Rising Cumilla - Sundarban
ছবি: সংগৃহীত

সুন্দরবনে আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জলদস্যুদের দল। গত কয়েক মাসে উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে ও বনজীবীদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় এবং নির্যাতনের ঘটনায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বনভূমিতে জীবিকা নির্বাহ করতে যাওয়া মানুষজন এখন দস্যু বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘মাশুল’ পরিশোধের পরেই বনে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছেন।

অন্যথায় জিম্মি, শারীরিক নির্যাতন এমনকি সর্বস্ব হারানোর মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন তারা। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে এক প্রকার অপরাধীদের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্র ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকা থেকে শতাধিক জেলে ও বাওয়ালিকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করেছে একাধিক জলদস্যু বাহিনী। অপহৃত জেলেদের কাছ থেকে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে। বিকাশের মাধ্যমে টাকা পরিশোধের পরই তারা ছাড়া পেয়েছেন। মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হলে অনেককেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এর আগে সুন্দরবন ও কক্সবাজার এলাকায় দেড় শতাধিক জলদস্যু অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করলেও তাদের অনেকেই নতুন করে দস্যুতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। তবে এবার তারা সরাসরি নিজেদের নামে বাহিনী না গড়ে তুলে নতুন কোনো ব্যক্তিকে সামনে রেখে তাদের নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, সুন্দরবনে নতুন করে অন্তত ১০টি জলদস্যু বাহিনী সক্রিয় হয়েছে। যদিও কোস্ট গার্ড সদর দপ্তর থেকে শুধুমাত্র আলিফ ও কলিম শরীফ বাহিনীর তথ্য নিশ্চিত করেছে।

স্থানীয়দের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর আত্মসমর্পণ করা সুন্দরবন অঞ্চলের প্রায় সকল জলদস্যুই ফের দস্যুতার পথে পা বাড়িয়েছে। চলতি বছরের গত দুই মাসে তারা অন্তত ১৫০ জন জেলেকে অপহরণ করে ১০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ আদায় করেছে। সর্বশেষ অপহরণের শিকার হয়েছেন ৩৩ জন জেলে, যাদের মধ্যে ছয়জন নারীও রয়েছেন।

অপহরণের শিকার জেলেরা জানান, বনাঞ্চলের গভীরে নির্জন স্থানে তাদের আটকে রেখে দিনের পর দিন ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং মুক্তিপণ আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়।

খুলনার দাকোপ উপজেলার জেলে ফারুক হোসেন সম্প্রতি মাছ ধরতে গিয়ে আরও চারজনের সঙ্গে জলদস্যুদের হাতে পড়েন। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের গভীর বনে নিয়ে যাওয়া হয়। শারীরিক নির্যাতনের পর বিকাশে টাকা পাওয়ার পরেই তাদের ছেড়ে দেয় দস্যুরা।

শ্যামনগরের জেলে রবিউল শেখ জানান, ছয়জনকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে গিয়েছিল দস্যুরা। মুক্তিপণের টাকা সময়মতো না পাঠানোয় তাদের একজনকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এই ঘটনায় তারা এতটাই আতঙ্কিত যে এখন আর সুন্দরবনে যেতে সাহস পাচ্ছেন না।

কয়রার জেলে আব্দুল জলিল তার ভাইয়ের অপহরণের কথা জানিয়ে বলেন, দস্যুরা শুধু তার ভাইকেই নেয়নি, মাছ, জাল, ট্রলার সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে। তার ভাই ফিরে এলেও সেই ভয়াবহ স্মৃতি এখনও তাকে তাড়া করে ফেরে।

জেলেদের ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সুন্দরবনে শরীফ বাহিনী, দয়াল বাহিনীসহ অন্তত সাত থেকে আটটি নতুন জলদস্যু বাহিনী সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি বাহিনীতে আট থেকে দশ জন সদস্য রয়েছে এবং তাদের হাতে রয়েছে দেশীয় রাইফেল, দো-নালা বন্দুক ও ধারালো অস্ত্র। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কোস্ট গার্ডের কয়েকটি অভিযানে বেশ কয়েকজন জলদস্যুকে আটক করা হয়েছে এবং অপহৃত জেলে ও বাওয়ালিদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। গত ছয় মাসে পরিচালিত অভিযানে ২৪টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৬০টি দেশীয় অস্ত্র, গুলি ও হাতবোমা উদ্ধার করেছে কোস্ট গার্ড।

বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের (পশ্চিম জোন) জোনাল কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী হাসান সুন্দরবনে জলদস্যুদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধির কথা স্বীকার করে বলেন, “আমরাও আমাদের কার্যক্রম জোরদার করেছি। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে আমরা বেশ কিছু জলদস্যুদের আস্তানার সন্ধান পেয়েছি এবং সেগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি অভিযানে আমরা ৩৩ জন জেলেকে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। সুন্দরবনে কেউ দস্যুতা করার চেষ্টা করলে কঠোর হস্তে দমন করা হবে।”

সুন্দরবন বন বিভাগের বন সংরক্ষক মো. ইমরান হোসেন বলেন, “সুন্দরবনকে জলদস্যুমুক্ত করা বন বিভাগের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য আমরা কোস্ট গার্ড, নৌ-বাহিনী, র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা চেয়েছি। তাদের সহায়তায় আমাদের তদারকিও বাড়ানো হয়েছে। আমরা একটি আলাদা টিম গঠনের পরিকল্পনা করছি যা এই দস্যুতা দমনে কাজ করবে। আশা করছি খুব দ্রুতই সুন্দরবন আবারও নিরাপদ হয়ে উঠবে।”