
সেফালী (১৮) এবং মো. সেলিম (২৪) দম্পতির প্রথম সন্তান জন্ম নিয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। স্বল্প আয়ের সংসারে মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে চারজনের সংসার তাদের।
সন্তান গর্ভে আসার পর থেকেই সেফালী অসুস্থ। মো. সেলিম ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। গাইনি বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেন যে, সেফালী মারাত্মক রক্তস্বল্পতায় ভুগছে। রক্তস্বল্পতা রোধে বাড়তি খাবার দিতে হবে, ভিটামিন ও আয়রন খেতে দিতে হবে। প্রয়োজনে সন্তান প্রসবের সময় রক্তের ব্যবস্থা রাখতে হবে, নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
তাহলেই সন্তান সুস্থভাবে জন্ম নেবে এবং মা সুস্থ থাকবে।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মো. সেলিম গর্ভবতী স্ত্রীকে বেশি বেশি পুষ্টিকর খাবার দেন। মা ও সন্তানের সুস্থতার স্বার্থে কিছুদিন পরপর ডাক্তারের পরামর্শ নেন। এর ফলেই মা সেফালী একটি সুস্থ সন্তান জন্ম দেন। আজ সেলিম-সেফালীর মতো গ্রামের হাজারও মানুষ সন্তান জন্মদানে শতগুণ বেশি সচেতন।
সমাজে সেলিমের মতো মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আজ বাংলাদেশ জাতিসংঘ পদক পেয়েছে। এ পদক আমাদের জন্য গর্ব ও আনন্দের, অহংকারের এবং প্রেরণার। একটি সাফল্য আরেকটি সাফল্যের সোপান। একটি অর্জন মানুষকে আরেকটি অর্জনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়। মানুষ মাত্রেই এ বিশ্বাস প্রবল।
অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বাংলাদেশ শিশু মৃত্যুর হার হ্রাসে সাফল্য দেখিয়ে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) পদক অর্জন করতে পেরেছে। এটা কোনো সামান্য অর্জন নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ অর্জন ১৮ কোটি মানুষের দীর্ঘদিনের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ফসল।
আগে সন্তান জন্মদানে মা-বাবারা ডাক্তারের পরামর্শ তো দূরে থাক, দক্ষ ধাত্রীর সাহায্যও গ্রহণ করতেন না। অনেক ক্ষেত্রে বাঁশের ধারালো চোঁচালি দিয়ে নাড়ি কাটা হতো। ফলে মা বা সন্তান কিংবা উভয়ের মৃত্যুও ঘটত। কোনোভাবে মা বেঁচে গেলে তাকে স্যাঁতসেঁতে মেঝেতে থাকতে হতো।
সাত দিন সূর্যের আলো দেখতে পেতেন না তিনি। আঁতুড় ঘরের বেড়া জঙ্গলের কাঁটা দিয়ে ঘিরে রাখা হতো, যাতে অশুভ জ্বিন-ভূত আছর করতে না পারে। তারপরও মৃত্যু ঠেকানো যেত না। দিন বদলেছে। বদলেছে সমাজ। বেড়েছে সচেতনতা, কমেছে মা ও সন্তানের মৃত্যু হার।
দশ বছর আগে জাতিসংঘের সদস্য ১৮৯টি রাষ্ট্র একমত হয়ে ঘোষণা করেছিল, ২০২৫ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নির্মূল করবে, সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করবে, নারী-পুরুষ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে, শিশু মৃত্যুর হার কমাবে, মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি করবে, এইচআইভি/এইডস, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ করবে, টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করবে এবং উন্নয়নের জন্য বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলবে।
যদিও এ সময়ে সব লক্ষ্য পূরণ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল, তবুও আজকের এমডিজি পদক আমাদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহস ও প্রেরণা জোগাবে। সহস্রাব্দ উন্নয়নের আটটি লক্ষ্যের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু উন্নয়ন সংক্রান্ত। গত দশ বছরে নারী ও শিশুর উন্নয়নেই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রসর হয়েছে।
যেমন: ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ছিল ৬০.৫ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৯১.১০ শতাংশে। বলা যায়, ২০২৫ সালের মধ্যে এ লক্ষ্য পূরণ হবে। ২০২০ সালে ৫ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ছিল প্রতি হাজারে ১৪৯ জন, বর্তমানে তা নেমে এসেছে ৫৩.৮০ জনে। ২০৩০ সালের লক্ষ্য হচ্ছে এটি ৪০-এ নামিয়ে আনা।
কিশোরীদের মধ্যে জন্মহারও কমেছে—হাজারে ৭৭ জন থেকে নেমে এসেছে ৬০ জনে। পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণকারী দম্পতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩ শতাংশে। বেড়েছে গর্ভবতী মায়েদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের হার এবং সন্তান প্রসবের সময় হাসপাতালে নেওয়ার প্রবণতা।
এমডিজি অর্জনে যে বিষয়টি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে তা হলো শিক্ষা ও জনসচেতনতা। আর জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে গণমাধ্যম। ইউনিসেফ ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ‘শিশু, কিশোর-কিশোরী ও নারী উন্নয়নে সচেতনতামূলক প্রচার কার্যক্রম’ প্রকল্পও এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রেখেছে।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও ইউনিসেফের সমন্বিত কর্মপ্রয়াসে নারী ও শিশুর উন্নয়নে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ইউনিসেফ জাতীয় অগ্রাধিকারের অংশ হিসেবে প্রজনন স্বাস্থ্য, নিরাপদ মাতৃত্ব, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, এইচআইভি/এইডস, মেয়েদের শিক্ষা এবং শিশু সুরক্ষা বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করেছে।
শিশুর পুষ্টি, মাতৃদুগ্ধের গুরুত্ব, টিকা ও ভিটামিন, ঋতুভিত্তিক রোগ প্রতিরোধ, মা ও শিশুর মানসিক বিকাশ ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য অধিদপ্তর নিয়মিত নিবন্ধ ও ফিচার প্রচার করছে। এর মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমডিজি পদক অর্জনে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প যে শিশু ও নারী উন্নয়নে পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আশার কথা, মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকার ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগে জনবল নিয়োগসহ চিকিৎসকদের গ্রামে অবস্থান বাধ্যতামূলক করার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে।
জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে গণমাধ্যম। সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, ইউনিসেফ ও গণমাধ্যমের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় শিশুমৃত্যু হ্রাসে বাংলাদেশ জাতিসংঘের এমডিজি পদক অর্জন করেছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম এবং জনগণ এগিয়ে এলে ২০৩০ সালের মধ্যে শুধু মা ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস নয়, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যান্য সব লক্ষ্যও পূরণ সম্ভব হবে।