মার্চ ৬, ২০২৫

বৃহস্পতিবার ৬ মার্চ, ২০২৫

যেভাবে কাটছে যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজাবাসীর জীবন

Palestinians Gaza
গাজা উপত্যকার একটি বিধ্বস্ত ভবনে নারী ও শিশুরা। ছবি: এপি

রাতের ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার কেমন যেন একটা ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি করে, যা কোমলমতি শিশুদের মনে ভয়ের সৃষ্টি করে। যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত গাজার রাতগুলো যেন অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে আরও বেশি ভয়ানক!

গাজা উপত্যকায় যখন রাত নামে ভাঙা ঘরবাড়ির বিভিন্ন অংশ অন্ধকারে ঢেকে গিয়ে ভয়ার্ত দৃশ্য তৈরি করে। এতে আতঙ্কিত হয় শিশুরা।

ইসরায়েলের তান্ডবে নিজের বাড়ি বিধ্বস্ত হলেও ধংসস্তূপের মধ্যেই বাস করছেন ফিলিস্তিনি নারী রাওয়া তাম্বুরা ও তার বাচ্চারা। তবে রাত হলেই অন্ধকারে নিজেদের বাড়ির ভগ্নদশায় ভয় পায় তার ছেলেরা।

ভয় তাড়াতে বাধ্য হয়ে মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে রাখেন তাম্বুরা। অবশ্য যতক্ষণ চার্জ থাকে মোবাইলে। পনেরো মাসের হামলায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে গাজায়। তার কর্মস্থলে থাকা একটি জেনারেটরে রোজ চার্জ করে আনেন মোবাইল।

দীর্ঘ ১৬ মাস পর বাড়ি ফিরেছেন তাম্বুরা। যদিও বাড়ি বলতে সেই অর্থে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে পানি, বিদ্যুৎ, তীব্র শীতে উষ্ণতা পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা, এমনকি ময়লা আবর্জনা দূর করার উপায়ও তাদের নেই।’

জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গাজায় যুদ্ধ-বিরতি কার্যকর হওয়ার পর প্রায় ৬ লাখ বাস্তুচ্যুত গাজাবাসী প্রবল আগ্রহ উদ্দিপনা নিয়ে নিজেদের বাসস্থানে ফিরেছিলেন।

তবে ঘরে ফেরার আনন্দে বিভোর গাজাবাসী ধীরে ধীরে অনুভব করতে শুরু করেছেন তাদের কঠোর বাস্তবতা। ঠিক কতদিন তাদের এই মানবেতর জীবনযাপন করতে হবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

কয়েক কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে খাবার পানি আনেন তারা। নেই খাবারেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। খাবার রান্না করতে হলে মাইলের পর মাইল খুঁজতে হয় জ্বালানি। ভাঙা বাড়িঘর গুলো থেকে ইট-পাথর সরানোর মতো কোনো সরঞ্জামও নেই গাজাবাসীর কাছে।

তাম্বুরা বলেন, ‘গাজাবাসী এতটা কষ্টে রয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন এরকম যুদ্ধবিরতির চেয়ে তারা যুদ্ধে শহীদ হলেই ভালো হতো।’ তিনি বলেন, ‘আমি জানি না, ভবিষ্যতে আমরা কি করবো, আমি আর কিছু চিন্তা করতে পারছি না।’

এদিকে, আগামী শনিবার (১ মার্চ) শেষ হতে চলেছে যুদ্ধবিরতি চুক্তির প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপ নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। পুনরায় চুক্তি হবে কিনা তা অনিশ্চিত। যদি চুক্তি না করে ইসরায়েল পুনরায় হামলা করে অসহায় গাজাবাসীর ভাগ্যে কি রয়েছে, তারা নিজেরাও তা জানেন না। আশ্রয়ের সন্ধানে কোথায় যাবেন জানেন না দুর্ভাগা মানুষগুলো।

অন্যদিকে ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই গাজার পুনর্গঠন নিয়ে নানা পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের হিসাব মতে গাজাকে ফের বসবাসযোগ্য করে তুলতে প্রায় ৫৩০ কোটি টাকা (৫৩ বিলিয়ন ডলার) প্রয়োজন। তবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কিভাবে আর কোন উৎস থেকে আসবে তা নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রাথমিকভাবে মানুষগুলো যেন কোনোভাবে বাস করতে পারে উপত্যকাটিতে সেটি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, আশ্রয়ের জন্য তাঁবু, খাবার পানি ও রান্না করার ব্যবস্থা করতে শুরু করেছে তারা।

তবে একদিকে ইসরায়েলের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত ঘরবাড়িতেই কোনোভাবে টিকে থাকার চেষ্টার মাঝেই আরেক শঙ্কা তৈরি করেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে গাজাবাসীদের অন্যত্র সরিয়ে তিনি গাজা দখল করার ঘোষণা দেন। এর আগে তিনি গাজাকে পুর্নগঠনের নামে তার ‘ক্লিন গাজা’ মিশনের কথা বলেন। তিনি মিসর ও জর্ডানে গাজাবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার কথা বলেন।

তবে ট্রাম্পের বক্তব্য ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছেন গাজার বাসিন্দারা। কোনো মূল্যেই তারা জন্মভূমি ত্যাগ করবেন না বলে জানান।

এই বিধ্বস্ত নগরীতেই নিজেদের অদৃষ্ট মেনে নিয়েই বাঁচতে শুরু করেছে গাজাবাসী। বৈইত লাহিয়ার তাম্বুরা রোজ ঘণ্টাখানেক হেঁটে গিয়ে একটি হাসপাতালে নার্সের চাকরি করেন। তার মাত্র ১২ বছর বয়সী ছেলে কয়েক কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করেন। তারা বাস করেন তাদের বাড়ির অর্ধেক ভাঙা একমাত্র রক্ষা পাওয়া রুমটিতে।

তাদের মতোই তেল আল হায়ার আসমা দাওইমাও ফিরেছেন নিজ বাসভূমে। কিন্তু তার বাড়িটির কিছুই অবশিষ্ট না থাকায় থাকছেন ভাড়া বাড়িতে। আসমা বলেন, ‘আমি এখানে ফেরার সাহস পাচ্ছিলাম না। সত্যটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল যে আমাদের বাড়িটা আর নেই।’

তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলিরা শুধু বাড়িই নয়, আমাদের স্বপও ভেঙে দিয়েছে।’ গাজার শহরে ফিরে ভাঙা বাড়ির ছোট একটি রুমে পুরো পরিবার নিয়ে বাস করছেন ২০ বছর বয়সী যুবক হুডা শায়েক। তার ভাষ্যে, অন্তত নিজের জন্মস্থানে তো রয়েছেন তারা।

এমনই মানসিক শক্তিতে বলীয়ান গাজাবাসী। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও জন্মভূমির মাটি আটকে পড়ে রয়েছেন গাজার মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছে, গাজার পুর্নগঠনে লাগতে পারে কয়েক দশক।

জাতিসংঘ, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অঞ্চলটিতে আরও বেশি পরিমানে ত্রান পাঠানোর চেষ্টা করছে।