
বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য নাম নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। তিনি শুধু বাংলার প্রথম এবং একমাত্র নারী নবাবই নন, বরং নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সমাজসেবায় এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলার জমিদারি ব্যবস্থায় যখন নারীদের ভূমিকা প্রায় অনুপস্থিত, সেই সময় তিনি দক্ষতার সঙ্গে জমিদারি পরিচালনা করেছেন, প্রজাদের কল্যাণে কাজ করেছেন, এবং নারীদের উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছেন।
প্রতিভার উন্মেষ
১৮৩৪ সালে কুমিল্লার লাকসামের পশ্চিমগাঁওয়ে এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে সাথে তিনি ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ দেখান। সে সময় মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত থাকলেও তিনি বাংলার পাশাপাশি আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
নারীদের শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা মুসলিম সমাজে একজন নারী হয়ে এতগুলো ভাষায় দক্ষতা অর্জন ছিল অত্যন্ত বিরল। শিক্ষিত হয়ে ওঠার এই আগ্রহই পরবর্তী সময়ে তাকে নারী শিক্ষার প্রসারে বড় ভূমিকা রাখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
জমিদারি ও সমাজসেবা
ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী বিয়ে করেছিলেন জমিদার গাজী চৌধুরীকে, তবে পরবর্তীতে তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। সেই সময় দেনমোহর বাবদ পাওয়া এক লক্ষ এক টাকা তিনি নিজ উদ্যোগে ব্যবহার করেন—নিজের জন্য নির্মাণ করেন এক জমিদার বাড়ি এবং শুরু করেন জমিদারির প্রশিক্ষণ।
১৮৭০ সালের পর থেকেই তিনি জমিদারির দায়িত্ব দেখতে শুরু করেন এবং ১৮৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে জমিদার নিযুক্ত হন। তার শাসনামলে তিনি প্রজাদের প্রতি উদার ছিলেন এবং তাদের সুখ-দুঃখের অংশীদার হন। তার সময়কালে জমিদারির এলাকায় কোনো ধরনের দাঙ্গা বা বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি, যা তার শাসন দক্ষতারই প্রমাণ।
নওয়াব উপাধির প্রাপ্তি
ফয়জুন্নেসার জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য ব্রিটিশ সরকার প্রথমে তাকে ‘বেগম’ উপাধি দিতে চেয়েছিল। তবে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন, কারণ তিনি মনে করতেন, তার প্রজারা তাকে এমনিতেই বেগম হিসেবে সম্মান করে।
পরবর্তীতে, তিনি যখন ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. ডগলাসকে এক লক্ষ টাকা দান করেন—তাও কোনো সুদ ছাড়াই—তখন এই ঘটনা রানী ভিক্টোরিয়ার নজরে আসে।
ইংল্যান্ড থেকে অনুসন্ধানকারী দল পাঠানো হয়, এবং তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে ১৮৮৯ সালে রানী ভিক্টোরিয়া তাকে ‘নওয়াব’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
এভাবে তিনি বাংলার প্রথম এবং একমাত্র নারী নবাব হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেন।
নারী শিক্ষার অগ্রদূত
ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী শুধুমাত্র জমিদার বা নবাব ছিলেন না, তিনি ছিলেন নারী শিক্ষার অগ্রদূত। ১৮৭৩ সালে, বেগম রোকেয়ার জন্মের আগেই, তিনি কুমিল্লায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তীতে কলেজে রূপান্তরিত হয়। তার জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ১৪টি মৌজার প্রতিটিতে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
এছাড়া, দরিদ্র মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি হোস্টেলের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং মেয়েদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থাও করেন।
নারী স্বাস্থ্য ও জনহিতকর কাজ
১৮৯৩ সালে তিনি দরিদ্র মহিলাদের জন্য ‘ফয়জুন্নেসা জেনানা হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ছিল সেই সময়ের অন্যতম নারী স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে মুসলিম নারী রোগীরা পর্দার আড়ালে চিকিৎসা নিতে পারতেন।
তার জনহিতকর কাজ এখানেই থেমে থাকেনি। তিনি তার জমিদারি থেকে প্রাপ্ত সম্পদের বড় অংশ ওয়াকফ করে দেন, যা থেকে কুমিল্লার দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা আজও বৃত্তি পেয়ে থাকে।
এছাড়া, তিনি রাস্তাঘাট নির্মাণ, দীঘি-জলাশয় খনন, মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণেও অবদান রাখেন।
এক সাহিত্যিক নবাব
ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন বাংলা ভাষায় প্রথম মুসলিম নারী সাহিত্যিক। ১৮৭৬ সালে তার লেখা ‘রূপজালাল’ প্রকাশিত হয়, যা ছিল মুসলিম নারীদের লেখা প্রথম বাংলা গ্রন্থ। এটি মূলত রূপকের মাধ্যমে তার আত্মজীবনীমূলক একটি রচনা।
এছাড়া, তার লেখা আরও দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়—‘সঙ্গীত লহরী’ ও ‘সঙ্গীতসার’।
শেষ দিনগুলো ও উত্তরাধিকার
১৯০৩ সালে ৬৯ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার স্মৃতি আজও অমলিন হয়ে আছে তার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও দাতব্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
তার বাড়ির পাশে নির্মিত ‘নওয়াব ফয়জুন্নেছা জামে মসজিদ’ আজও দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাদের জন্যও নামাজের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যা তার সময়ের চেয়ে অনেক অগ্রগামী চিন্তার প্রতিফলন।
এক অনন্য নারী, এক অনন্য কীর্তি
নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন এক দৃঢ়চেতা, প্রজা-হিতৈষী, শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবী নারী।
তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে নারীর ক্ষমতায়ন শুধু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং শিক্ষা, সাহিত্য ও সমাজসেবায়ও নারীরা অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।
আজও তার অবদান বাংলার ইতিহাসে এক অমর কীর্তি হয়ে রয়েছে। নারী ক্ষমতায়ন ও সমাজসেবার প্রতীক হিসেবে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।