
কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার গ্রামীণ জীবনে কৃষি ও মৎস্যচাষের ওপর নির্ভরশীল মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তবে এর ভেতর থেকে যারা নতুন চিন্তা, শ্রম এবং মেধা দিয়ে নিজেকে আলাদা করে তুলতে পারেন, তারাই হয়ে ওঠেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এমনই একজন সফল মানুষ রোকন সরকার। তার বাড়ি উপজেলার মেহার গ্রামে। তিনি একজন উচ্চ শিক্ষিত যুবক।
তিনি চান্দিনার একজন স্বনামধন্য মৎস্য ব্যবসায়ী ও চাষী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। দীর্ঘ দিনের অধ্যবসায়, পরিকল্পনা এবং আধুনিক কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি শুধু নিজের জীবনে সফলতা আনেননি, বরং এলাকাবাসীর জন্যও হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার প্রতীক।
রোকন সরকারের পথচলা শুরু হয়েছিল সীমিত পুঁজি আর বিশাল স্বপ্ন নিয়ে। প্রাথমিকভাবে একটি ছোট পুকুর লিজ নিয়ে তিনি মাছ চাষ শুরু করেন। ধীরে ধীরে তার পরিশ্রম, সততা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার ফলে মাছের উৎপাদন বাড়তে থাকে। এভাবে স্থানীয় বাজারে তার মাছের চাহিদা তৈরি হয়। পরবর্তীতে তিনি কয়েকটি বড় পুকুরে বিনিয়োগ করে মাছ চাষের পরিধি বাড়ান। বিশেষ করে রুই, কাতলা, মৃগেল ও পাঙ্গাশ চাষে তিনি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন। তার উৎপাদিত মাছ শুধু চান্দিনার বাজারেই নয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাগুলোতেও সরবরাহ করা হয়।
ব্যবসায়িক দিক থেকেও রোকন সরকার বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি মাছ বিক্রির জন্য একটি নিজস্ব সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে তিনি তার ব্যবসার বিস্তার ঘটিয়েছেন। ফলে মাছ বাজারজাতকরণে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয় না। পাশাপাশি তিনি আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছের রোগ প্রতিরোধ, খাদ্য ব্যবস্থাপনা এবং পানির মান নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট থাকেন।
রোকন সরকার শুধু নিজের উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। রোকন সরকারের মেসার্স “সরকার মৎস্য খামার” থেকে প্রতিদিন শত শত মন মাছ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলাতে সরবরাহ হয়ে থাকে। তার নিজের পুকুরে ও অন্যান্য জায়গায় ক্রয়কৃত মাছ ধরা ও দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করার জন্য শত শত যুবক কাজ করছে। রোকন সরকার জানান, আমার এ সরকার মৎস্য খামারে এলাকার শত শত বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমার এ মাছ প্রতিদিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছানোর জন্য আমার কিছু নিজস্ব পরিবহন ও কিছু ভাড়া পরিবহন রয়েছে। তিনি আরও জানান, অর্থাভাবে তিনি বেশিদূর আগাতে পারেননি যদি তাকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সুদমুক্ত বা স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া হতো তাহলে তিনি দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে ও দেশের জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারতেন।
২০০১ সাল থেকে নিজ উদ্যাোগে মাছ চাষ শুরু করেন। তখন তার কোন এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ ছিল না। ২০১৫ সালে তার নিজ উপজেলা চান্দিনা যুব উন্নয়ন হতে মৎস্য চাষের ওপর ৩ দিনের একটি প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর তিনি নিজেকে মাছ চাষের উপর আরও বেশী আত্মনিয়োগ করেন। তার মাছ চাষের সফলতা দেখে আশপাশের অনেক বেকার যুবক আজ মাছ চাষে উৎসাহিত হয়েছেন। তিনি নিজ হাতে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, কখন কীভাবে পুকুর প্রস্তুত করতে হবে, কোন মৌসুমে কোন প্রজাতির মাছ চাষ উপযুক্ত, এসব বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এর ফলে এলাকায় একটি বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বর্তমানে রোকন সরকারের সফলতার গল্প শুধু চান্দিনায় নয়, আশপাশের অঞ্চলেও পরিচিত। তার স্বপ্ন ভবিষ্যতে আরও আধুনিক পদ্ধতিতে বৃহৎ পরিসরে মৎস্য খামার গড়ে তোলা। তিনি বিশ্বাস করেন, মাছ চাষ শুধু একটি লাভজনক ব্যবসাই নয়, বরং গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করার একটি কার্যকর মাধ্যম।
রোকন সরকারের জীবনপ্রবাহ এটাই প্রমাণ করে যে, সৎ প্রচেষ্টা, অধ্যবসায় এবং সুপরিকল্পিত উদ্যোগ একজন মানুষকে কেবল সফল উদ্যোক্তা নয়, বরং সমাজের জন্য অনুকরণীয় পথপ্রদর্শক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।