
কুমিল্লার চান্দিনায় জমি বন্ধকের টাকা ফেরত চাওয়াকে কেন্দ্র করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মো. বাবুল (৫৫) নামে এক ব্যক্তিকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্ত্রী নুরজাহান বেগম বাদী হয়ে তিন জনের নাম উল্লেখ করে কুমিল্লা আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
গত মঙ্গলবার ৪ নভেম্বর সকাল ৯টার দিকে উপজেলার ২নং বাতাঘাসী ইউনিয়নের তীরচর গ্রামে, তীরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ওই ঘটনা ঘটে । এ ঘটনায় স্থানীয়ভাবে সমাধান না পেয়ে ৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার ১০৭/১১৪/১১৭(সি) ধারায় ওই মামলাটি করেন নুরজাহান বেগম। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুমিল্লা জেলা আইনজীবী সমিতি এডভোকেট সুলতান আহমেদ।
অভিযুক্তরা হলেন একই গ্রামের মৃত আলী মিয়ার ছেলে রবিউল হাসান (৪০), মৃত মোহন মিয়ার ছেলে জিসান (২৮) ও লোকমানের ছেলে রেজাউল (২২)।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, অন্ধ বাবুল মিয়া তৎকালীন মেম্বার আলম মিয়ার কাছ থেকে জমি বন্ধক নিয়েছিলেন। পরে আলম মিয়া’র অর্থের প্রয়োজন হওয়ায় সেই জমি তার ভাই রবিউলের কাছে বন্ধক দেয়। বন্ধকের সময় তিনি রবিউলকে নির্দেশ দেন যেন বাবুলের জমির বন্ধক টাকা ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু আলম মিয়া সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর থেকে বাবুল তার পাওনা টাকা ফেরতের জন্য একাধিকবার রবিউলের দ্বারে গিয়ে ফিরে আসছেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই টাকা ফেরত চাওয়াকে কেন্দ্র করেই সাম্প্রতিক মারধরের ঘটনাটি ঘটে। তবে এলাকার অনেকেই ভয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে চান না।
তীরচর গ্রামের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, অভিযুক্ত জিসান স্থানীয় এলডিপি উপজেলা গণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পাওয়ার পর থেকে বেপরোয়া আচরণ শুরু করেছে। বর্তমানে সে এলাকার সালিশি বৈঠকে “বিচারক” হিসেবে ভূমিকা রাখছে এবং প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও জিসান ও রবিউলের বিরুদ্ধে গোমতা এলাকায় পুকুর দখল, মাছ লুট ও চাঁদাবাজির অভিযোগে মুরাদনগর থানায় মামলা রয়েছে।
ভুক্তভোগী বাবুলের স্ত্রী ও মামলার বাদী নুরজাহান বেগম বলেন, “আমি আমার বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তা দিতে রাজি ছিলাম, কিন্তু রবিউল আমার বাড়ির মাঝ বরাবর রাস্তা করতে চায়। এতে রাজি না হওয়ায় তারা আমার বেড়া ভেঙে আমার ছেলে-মেয়েকে মারধর করে। আমি বিচার চাইলে কেউ কিছু করেনি। কয়েকদিন পর আমার বাড়িতে ডাকাতি হয়। আমি ভয় পাচ্ছি , তারা হয়তো বড় কিছু ঘটাতে পারে।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন, “আমার স্বামী বাবুল রবিউলের কাছে জমি বন্ধকের টাকা ফেরত চাইলে তাকে মারধ করে। স্থায়ীভাবে বিচার না পেয়ে আমি মামলা করার পর জিসান আমার বাড়িতে লোক পাঠিয়ে মামলা তুলে নিতে হুমকি দেয়। আমি চাই প্রশাসন বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখে ন্যায়বিচার দিক।”
অন্ধ বাবুল বলেন, “আমি চোখে দেখি না। আমি শুধু জমি বন্ধক রাখা আমার ২০ হাজার টাকা ফেরত চাইছিলাম। তখনই তারা কয়েক জন আমাকে মারে। পরে লোকজন উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসে।” এখন তাদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চাইছে না।
নিহত আলম মিয়ার স্ত্রী, পান্না আক্তার বলেন, “আমার স্বামী বাবুল মিয়ার কাছে জমি বন্ধক রেখে ২০ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। পরে অর্থের প্রয়োজন হলে আমি সেই জমি আমার দেবর রবিউলের কাছে বন্ধক দেই। জমি বন্ধকের সময় দেবর আমাদেরকে ওই পরিমাণ টাকা কম পরিশোধ করেন এবং বাবুলকে ২০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল। বাবুল তখন জমিতে চাষাবাদ করছিলেন। কথা ছিল বাবুল যদি জমি চাষ না করেন, তাহলে টাকা ফেরত পাবে। তার কয়েক মাস পরে আমার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর আমি বিষয়টি সম্পর্কে আর কিছু জানি না।”
স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁদা চেয়ে না পেয়ে গোমতা এলাকার একটি পুকুর থেকে জোর পূর্বক মাছ ধরে নেওয়ার সময় বাধাঁ দিলে বসতবাড়ীতে হামলা ও ভাঙচুর করে মারধরের চেষ্টার ঘটনায় জিসানকে ২ নং ও রবিউলকে ৩ নং আসামী করে ছয় জনের নাম উল্লেখ সহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামী করে স্থানীয় ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি মুরাদনগর থানায় ওই মামলা দায়ের করেন।
মামলা সম্পর্কে ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন জানান, “আমি ঘটনার সময় বাড়িতে ছিলাম না। আমার অনুপস্থিতিতে জিসান ও রবিউল সহ আরও কয়েক জন জোর করে পুকুর থেকে মাছ ধরতে যায়। আমার পরিবারের সদস্যরা বাধা দিলে তারা হামলা চালাতে উত্তেজিত হয়। পরে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আমার বসতবাড়ীতে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। এর আগে তারা আমার কাছে চাঁদা দাবি করে, চাঁদা না দেওয়ায় এই ঘটনা ঘটায়। তাই আমি প্রশাসনের কাছে দ্রুত বিচার ও নিরাপত্তা চেয়ে থানায় মামলা করি।
এবিষয়ে অভিযুক্ত জিসান অভিযোগ অস্বিকার করে বলেনে, আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা মিথ্যা ও বানোয়াট , আমি কাউকে গালাগাল করিনি এবং তুলে আনেতও বলিনি। আমাকে জড়িয়ে মুরাদনগর থানায় একটি মিথ্যা মামলা করা হয়েছে আমি ওইসবের সাথে জড়িত নই।
এই দিকে অন্ধ বাবুলকে মারধরের বিষয়ে অপর অভিযুক্ত রবিউল হাসান এস.ডু বলেন, বাবুল আমার কাছে টাকা পায় সত্য, সে সম্পর্কে আমার চাচা হয়। কিন্তু আমি তাকে মারধর করিনি, হাসি ঠাট্টার মাঝে একটি গালি দিয়ে চলে যেতে বলি। এখন যদি সে বলে আমি তাকে মারধর করেছি তাহলে কারো প্ররোচনায় বলছে। মামলার বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে এবিষয় অন্য অভিযুক্ত রেজাউল এর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এবিষয়ে ওয়ার্ড সদস্য মাইনুদ্দিন মাজেদ বলেন, “ঘটনাটির বিষয়ে আমি শুরু থেকেই অবগত ছিলাম। বিষয়টি যেন শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান হয়, সে জন্য আমি একাধিকবার উভয় পক্ষকে বসার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের মধ্যে আন্তরিকতার অভাব এবং পারস্পরিক অনীহার কারণে শেষ পর্যন্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি। আমি চাই প্রশাসন বিষয়টি সঠিকভাবে তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিক, যাতে এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে।”
এই ব্যাপারে ২নং বাতাঘাসী ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ছাদেকুর রহমান বলেন, এবিষয়ে আমাকে কেউ জানায়নি, আমি কিছুই জানিনা, তারা যদি আমার কাছে আসে সমাধানের চেষ্টা করবো।










