
কুমিল্লা জেলার চান্দিনায় এবার আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে, যা কেবল কৃষকের মুখে অনাবিল হাসিই ফোটায়নি, স্থানীয় কৃষি অর্থনীতিতে যোগ করেছে এক নতুন উদ্দীপনা। চলতি বছর চান্দিনা উপজেলায় মোট ৯১২৪ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে এক নতুন সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। উপজেলা কৃষি বিভাগের নিবিড় তত্ত্বাবধান, সঠিক সময়ে উন্নতমানের বীজ ও সার সরবরাহ এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির কার্যকর ব্যবহারের ফলেই এই বিপুল সাফল্য এসেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর আবহাওয়া ছিল চাষাবাদের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। মৌসুমের শুরু থেকে ধান পাকার সময় পর্যন্ত বন্যা বা বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ দেখা যায়নি। চারা রোপণ ও পরিচর্যার সময়ে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় কৃষকদের সেচের উপর নির্ভরতাও কম ছিল। প্রাকৃতিক সহায়তার পাশাপাশি, উপজেলা কৃষি কার্যালয় পুরো মৌসুম জুড়ে কৃষকদের সাথে ছিল ছায়ার মতো। নিয়মিত মাঠ পরিদর্শন, ফসলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ এবং আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির উপর প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়ায় কৃষকদের ভুল হওয়ার সুযোগ ছিল কম।
চান্দিনার কৃষকরা মূলত উচ্চ ফলনশীল জাতের (উফশী) ধান চাষে এবার বেশি আগ্রহী ছিলেন। ব্রি ধান-১১ (মুক্তা), ব্রি ধান-৪৯, ব্রি ধান-৭৬ এবং স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় কিছু উচ্চ ফলনশীল জাতের বীজ সরবরাহ করা হয়েছিল কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে। রোগ-বালাই দমনে এবার রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে সমন্বিত বালাই দমন (আইপিএম) পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া হয়। জৈব পদ্ধতি ব্যবহারে উৎসাহ ও প্রশিক্ষণ দেওয়ায় পরিবেশবান্ধব উপায়ে ধানের রোগ-পোকা দমন করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে একদিকে যেমন কীটনাশকের খরচ কমেছে, তেমনি উৎপাদিত ধানের গুণগত মানও উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে সার ব্যবস্থাপনায় কৃষি বিভাগের পরামর্শ ছিল অত্যন্ত কার্যকর। সুষম সার প্রয়োগের কৌশল শেখায় কৃষকরা জমিতে সারের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পেরেছেন, যা ফলন বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।
উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ধান ক্ষেতগুলো এখন সোনালী ফসলে ভরে উঠেছে। আরমাত্র কয়েকদিন পরই পুরোদমে ধান কাটার উৎসব শুরু হবে। উপজেলার কোথাও কোথাও কিছু কিছু ধান কাটা শুরু হয়ে গেছে। শ্রমিকরা দল বেঁধে ধান কাটছেন, কেউ কেউ ঐতিহ্যবাহী মাড়াই যন্ত্রের সাহায্য নিচ্ছেন। আবার কিছু আধুনিক কৃষক কম্বাইন হারভেস্টার বা রাইস ট্রান্সপ্লান্টার (যা চান্দিনায় সমলয় পদ্ধতিতে ব্যবহারের মাধ্যমে জনপ্রিয় হচ্ছে) এর মতো যন্ত্রের ব্যবহার করে দ্রুততার সাথে ফসল ঘরে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
চান্দিনা উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ মোরশেদ আলম জানান, “কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমরা একাধিক প্রদর্শনী প্লট তৈরি করেছিলাম, যেখানে উন্নত জাতের ধানের ফলন সরাসরি দেখানো হয়েছে। এর ফলে কৃষকরা নতুন জাত গ্রহণে উৎসাহিত হয়েছেন। আমাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, কম খরচে কৃষকরা যেন সর্বাধিক ফলন ঘরে তুলতে পারেন। এই বাম্পার ফলন চান্দিনার খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে।” তিনি আরও জানান, কৃষকদের ধান বিক্রির ক্ষেত্রে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে কৃষি বিভাগ স্থানীয় প্রশাসনের সাথে কাজ করছে, যাতে মধ্যস্বত্বভোগীরা সুবিধা নিতে না পারে। ধান বিক্রির পর একই জমিতে রবি শস্য (যেমন- সরিষা) চাষের জন্য কৃষকদের পরামর্শ ও বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে, যাতে জমির উর্বরতা বজায় থাকে এবং কৃষকরা সারা বছর লাভবান হতে পারেন।
মাইজখার ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন জানান, এবছর এই ইউনিয়নে ২০৩৫ হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ করা হয়েছে। ফসলের জন্য আবহাওয়া অনূকূল থাকায় এবং আমাদের কৃষি অফিসের সার্বিক সহযোগিতায় কৃষকেরা ধানের আশানুরূপ ফলন পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। মাইজখার ইউনিয়নের পানি পাড়া গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান,আলী কামোড়া গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ ইসমাইল জানান, প্রায় তিন দশক ধরে ধান চাষ করছেন, সন্তুষ্টি প্রকাশ করে জানান, “এবার ধানের শিষগুলো যেমন পুষ্ট হয়েছে, তেমনি চিটার পরিমাণও কম। মাইজখার ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ জালাল উদ্দীন, লোকজনের নিয়মিত খোঁজখবর ও পরামর্শ আমাদের কাজকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। গত কয়েক বছরে এমন ফলন পাইনি। ফলন বেশি হওয়ায় খরচ বাদে ভালো লাভ থাকবে বলে আশা করছি। বাজার দর ভালো থাকলে এবার আমাদের পরিবারের সব কষ্ট দূর হবে। চান্দিনার মাঠে এখন শুধু সোনালী ধানের সমাহার নয়, এটি যেন স্থানীয় কৃষি বিপ্লবের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। কৃষি বিভাগ ও কৃষকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার এই সাফল্য স্থানীয় জনগণের মুখে হাসি ফোটানোর পাশাপাশি জাতীয় খাদ্য উৎপাদনেও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।










