
চব্বিশের জুলাই-আগস্ট কেবল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া দিনই ছিল না; এটি ছিল জীবন-বদলের এক বিরল মুহূর্ত একটি এমন মঞ্চ, যেখানে সময় নিজেই মানুষের ভাগ্য পাল্টে দেওয়ার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দিনটি আবারও দেখিয়েছে যে, আল্লাহ চাইলে পরিবর্তনের জন্য খুব বেশি সময় প্রয়োজন হয় না। গত বছর পর্যন্ত যারা ছিলেন নিতান্তই সাধারণ, স্বপ্নবাজ কিন্তু অনাধুনিক তরুণ—নাহিদ, আসিফ মাহমুদ, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, মাহফুজ আলম, ওসমান—তাদের নাম আজ লাখো মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় শ্রদ্ধা ও আবেগ নিয়ে।
জুলাই-আগস্টের সেই উত্তাল সময় না এলে হয়তো তারাও নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শক্তিকে চিনতেই পারত না। হয়তো তাঁরা নিঃশব্দেই বড় হয়ে উঠত, আর জাতিও হারাত তাদের মতো উদীয়মান নেতৃত্বকে।
আমরাও হয়তো কখনো চিনতাম না সাদিক কায়েম, এস এম ফরহাদ বা মাঠে জীবন বাজি রেখে লড়াই করা সেই হাজারো অখ্যাত সৈনিকদের। আগস্টের পরিবর্তন না ঘটলে এসব নামই অচেনা থেকে যেত, তাদের স্বপ্নও হয়তো হারিয়ে যেত নিরাশার অন্ধকারে। কারণ তৎকালীন পরিস্থিতি ছিল এমন—স্বপ্ন দেখার মতো বাতাসও ছিল বিষণ্ন, আশা রাখার মতো পরিবেশ ছিল রুদ্ধ।
চব্বিশের পরিবর্তন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃশ্যপটকে যেমন বদলে দিয়েছে, তেমনি বদলে দিয়েছে মানুষের মনস্তত্ত্ব, জাতির আত্মবিশ্বাস। এই পরিবর্তন না এলে হয়তো ব্রিগেডিয়ার আযমীর সেই দৃঢ়, স্পষ্ট ও সাহসী উচ্চারণ আমরা কখনো শুনতেই পেতাম না।
ব্যারিস্টার আরমানের মতো কণ্ঠস্বরও হয়তো আমরা কোনোদিন শুনতে পেতাম না। মৃত ভেবে এখনও তার পরিবার হয়তো প্রতিবছর দোয়ার আয়োজন করতো। এটিএম আজহারুল ইসলামের মতো মানুষের মুক্তি হয়তো আজও দূর স্বপ্নই রয়ে যেত। যে বিচার একসময় অমীমাংসিতভাবে ঝুলে ছিল, সেই বিচারও পেয়েছে নতুন গতি আগস্টের চেতনাতেই।
এমনকি ডাকসু, জাকসু, রাকসুর মতো ঐতিহাসিক ছাত্র সংসদ নির্বাচন—যা তরুণদের গণতান্ত্রিক অনুশীলন ফিরিয়ে দিয়েছে—সেগুলোরও সম্ভাবনা ছিল অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার। ছাত্রসমাজের প্রতি অবিশ্বাস ও অবহেলা হয়তো আরও দীর্ঘকাল টিকে থাকত। অথচ এই নির্বাচনগুলোই আবার নতুন প্রজন্মের রাজনীতিতে আলো জ্বালিয়েছে, তৈরি করেছে দায়িত্বশীল নেতৃত্বের পথ।
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে শুধু পাল্টায়নি; এটি একটি জাতিকে শ্বাস নিতে শিখিয়েছে সততার বাতাসে, চলতে শিখিয়েছে মাথা উঁচু করে। তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের উদ্ধত আচরণ ও ক্ষমতার দম্ভ হয়তো আজও আমাদের উপর অন্ধকারের মেঘের মতো ভর করে থাকত। পলক নামের ক্ষুদ্র ক্ষমতাবাজ গোষ্ঠীর দৌরাত্ম্য হয়তো আরও বাড়ত, আর সাধারণ মানুষ নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ছাড়ুক বা অন্তরে গুম হয়ে থাকুক—এই দুই পথের একটাকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নিত। এ পরিবর্তনই সেই ভয়কে ভেঙে দিয়েছে।
ইতিহাসও কখনো কখনো এমন অবিশ্বাস্য নাটক রচনা করে, যা কল্পনাকেও হার মানায়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যিনি একসময় শেখ হাসিনার আদালতে দণ্ডিত হয়ে কারাবরণের দ্বারপ্রান্তে ছিলেন, সময় ঘুরে এমন এক অবস্থার জন্ম দিয়েছে যেখানে সেই শেখ হাসিনাই আজ দণ্ডিত ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের আদালতে। এটি ইতিহাসের নির্মম কিন্তু ন্যায়সংগত এক প্রতিফলন, যা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়—ক্ষমতা স্থায়ী নয়, অহংকারেরও শেষ আছে, এবং আল্লাহর পরিকল্পনাই সর্বশ্রেষ্ঠ।
সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং চোখ খোলার মতো বিষয় হলো—এই বিপরীতধর্মী, অভাবনীয় পরিবর্তনগুলো ঘটেছে আমাদের সরাসরি চোখের সামনে, আমাদের জীবদ্দশাতেই। ইতিহাসের অধ্যায়ে এমন নাটকীয় মোড় দেখা বিরল। অনেক জাতির ইতিহাসে এরকম পরিবর্তন দেখতে কয়েকদশকের বেশি সময় লাগে; প্রায়শই এর জন্য প্রয়োজন হয় কয়েক যুগ, কখনো শতাব্দীরও বেশি সময়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে, মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে আমরা সাক্ষী হয়েছি এমন এক অভূতপূর্ব ঘটনার—যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃশ্যপট একসাথে পাল্টে গেছে, ক্ষমতার ভারসাম্য পুরোপুরি উল্টে গেছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন আশা, সাহস ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত হয়েছে।
ক্ষমতা কখনো চিরস্থায়ী নয়। কোনো রাষ্ট্রের শাসকই চিরকাল ক্ষমতায় থাকতে পারে না, কোনো দলের প্রভাবই স্থায়ী নয়। মানুষ যতই শক্তিশালী মনে করুক, বাস্তবে পরিবর্তন এবং নিয়ন্ত্রণ সর্বদাই মহান আল্লাহর হাতে। মানুষের পরিকল্পনা, কৌশল ও চেষ্টাই যতই নিখুঁত হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছা এবং সময়ের গতিপথই ইতিহাস নির্ধারণ করে।
অতএব, এই দেড় বছরের অভূতপূর্ব পরিবর্তন আমাদেরকে শুধু রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার শিক্ষা দেয়নি; এটি আমাদের চেতনায় গভীরভাবে প্রভাব ফেলেছে। আমাদের শেখায়—ভয় ও হতাশা কখনো চূড়ান্ত নয়, ধৈর্য, সাহস এবং সঠিক সময়ে কার্যকর আন্দোলন যেকোনো বিপরীতধর্মী পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে। আমাদের শিক্ষা হলো, আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে সময়ও মানুষের সহায়ক হয়, আবার চাইলে প্রতিকূলতার দেয়াল হিসেবে দাঁড়ায়, যা জয়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষকে পরীক্ষা করে। এই সবকিছু আমাদের জীবনের বাস্তবতায় আমাদের সামনে ঘটেছে—একটি অভূতপূর্ব শিক্ষণীয়, স্মরণীয় ও অনুপ্রেরণামূলক বাস্তবতা।
চব্বিশের আগস্ট তাই শুধু একটি দিন নয়; এটি এক জাতির আশা, সংগ্রাম এবং নতুন জন্মের ঘোষণা। এটি স্মরণ করিয়ে দেয়—মানুষ যতই শক্তিশালী ভাবুক, শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রক একমাত্র আল্লাহ। আর তিনি চাইলে ইতিহাসের গতিপথ বদলে যেতে পারে মুহূর্তেই।










