জুন ২৩, ২০২৫

সোমবার ২৩ জুন, ২০২৫

হলুদ সাংবাদিকতা নাকি দায়বদ্ধ সাংবাদিকতা

গ্রাফিক্স: প্রতীকী ছবি (লেখক)

বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যম শুধু খবর প্রচারের একটি মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক প্রতিষ্ঠান যা জনমত গঠন, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ এবং গণতন্ত্রের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

তবে এই শক্তিশালী মাধ্যমটির একাংশ আজ প্রশ্নবিদ্ধ; বিশেষ করে যখন হলুদ সাংবাদিকতা তার পায়ের নিচে দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার নৈতিক ভিত্তিকে পদদলিত করে চলে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে গণমাধ্যমের এ ধরনের প্রবণতা গণতন্ত্র, সামাজিক ভারসাম্য এবং তথ্যের নির্ভরযোগ্যতার ওপর একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

হলুদ সাংবাদিকতা, যাকে ইংরেজিতে “Yellow Journalism” বলা হয়, মূলত এমন এক ধরণের সাংবাদিকতা যা তথ্যের যথার্থতা বা বস্তুনিষ্ঠতার তোয়াক্কা না করে, চাঞ্চল্য সৃষ্টি করাই যার মূল লক্ষ্য।

অতিরঞ্জিত শিরোনাম, মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য, গুজব প্রচার, ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং অশ্লীল বা উত্তেজক উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠক বা দর্শককে আকৃষ্ট করার এ প্রবণতা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য যথেষ্ট।

এই ধারা অনেক সময় ব্যক্তি, পরিবার বা গোষ্ঠীর মানহানি ঘটায় এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়।

এদিকে দায়বদ্ধ সাংবাদিকতা সম্পূর্ণ বিপরীত এক ধারা। এটি বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সংগ্রহ, যাচাই-বাছাই, এবং নৈতিকতা অনুসরণের মাধ্যমে গঠিত। দায়বদ্ধ সাংবাদিকতা গণমাধ্যমকে একটি বিশ্বস্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে, যেখানে জনগণ সত্যিকারের খবর পায় এবং তাদের চিন্তা, মত ও সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে গঠিত হয়।

এই ধারার সাংবাদিকরা নৈতিক আদর্শ, পেশাগত মান এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেন। তারা ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহির আওতায় আনেন, নিপীড়িতদের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের বাহক হন।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে; এই দুই প্রবণতার মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের গণমাধ্যম কোন দিকে এগোচ্ছে? দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে বাংলাদেশের অনেক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বস্তুনিষ্ঠতা ও দায়বদ্ধতার পরিবর্তে হলুদ সাংবাদিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এর পেছনে রয়েছে বিভিন্ন প্রভাব ও কারণ।

প্রথমত, বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা। পাঠকসংখ্যা, দর্শকসংখ্যা বা অনলাইন ভিউ বাড়াতে গিয়ে অনেক সংবাদমাধ্যম সংবাদের চেয়ে ‘সেনসেশন’ বা চাঞ্চল্য তৈরির দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।

‘ক্লিকবেইট’ শিরোনাম, অর্ধসত্য তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর উপস্থাপনা; সবই মূলত বিজ্ঞাপন দাতাদের মন জয় করে বেশি রাজস্ব আয় করার একটি উপায় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক প্রভাব। অনেক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। ফলে নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা বিঘ্নিত হয়।

তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো দলকে ‘হিরো’ আর বিরোধী পক্ষকে ‘ভিলেন’ হিসেবে উপস্থাপন করে। এই ধরনের সাংবাদিকতা কেবল একটি মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে, কিন্তু গণতন্ত্র ও জনমত গঠনের সঠিক পথকে ব্যাহত করে।

তৃতীয়ত, প্রশিক্ষণের অভাব ও পেশাগত মানহীনতা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সাংবাদিকদের প্রয়োজনীয় নৈতিক ও পেশাগত প্রশিক্ষণ নেই। সাংবাদিকতা কেবল একটি চাকরি নয়, এটি একটি দায়িত্বপূর্ণ পেশা।

এই পেশার মানুষের একটি স্বচ্ছ মানসিকতা, সত্যনিষ্ঠতা এবং নৈতিক মেরুদণ্ড থাকা দরকার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই মান অনেক ক্ষেত্রেই রক্ষা করা হচ্ছে না।

চতুর্থত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব। ফেসবুক, ইউটিউব বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে কেউ ইচ্ছা করলেই সংবাদ উপস্থাপন করতে পারে, এমনকি নিজেকে সাংবাদিক বলেও পরিচয় দিতে পারে।

এখানে যাচাই-বাছাইয়ের কোনো নিয়ম নেই, ফলে গুজব, অপপ্রচার এবং মনগড়া গল্প ছড়ানোর একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। অনেক মূলধারার সংবাদমাধ্যমও এই প্ল্যাটফর্মগুলোর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে গিয়ে নিজেদের মান ও নীতিবোধ বিসর্জন দিচ্ছে।

তবে এই হতাশাজনক বাস্তবতার মাঝেও কিছু আশাব্যঞ্জক দিক রয়েছে। এখনো কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিক রয়েছেন যারা নিরলসভাবে সত্য প্রকাশে কাজ করে চলেছেন, নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতা বজায় রেখে পেশার মর্যাদা রক্ষা করছেন। এমন সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ হয়ে উঠেন, যারা শুধু তথ্য দেন না, বরং জনসচেতনতা গড়ে তোলেন।

এছাড়াও এখন পাঠক ও দর্শকও আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা অনেক সময়ই বিভ্রান্তিকর সংবাদ বা হলুদ সাংবাদিকতার প্রচারণার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। সামাজিকভাবে সচেতন পাঠক সমাজই পারে হলুদ সাংবাদিকতার বিস্তার রোধ করতে।

এ পর্যায়ে রাষ্ট্র ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোরও দায়িত্ব রয়েছে; যাতে হলুদ সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে কার্যকর নীতিমালা ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, এবং দায়বদ্ধ ও মানসম্পন্ন সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করা হয়।

পাশাপাশি সাংবাদিকতা শিক্ষার মানোন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতা বিষয়ে পাঠক্রম বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, গণমাধ্যমের নৈতিকতা আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক চাপে ভারাক্রান্ত হলুদ সাংবাদিকতা, অন্যদিকে দায়বদ্ধতা ও বস্তুনিষ্ঠতার আদর্শকে আঁকড়ে ধরা কিছু সাহসী কণ্ঠস্বর।

এই সংঘর্ষে কোন ধারা জয়ী হবে, তার ওপর নির্ভর করবে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ, সমাজের স্থিতিশীলতা এবং সত্যের জয়ের পথ। সময় এসেছে আমাদের প্রত্যেকের, বিশেষ করে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্টদের, আত্মসমালোচনার মাধ্যমে প্রশ্ন করার।

আমরা কি সত্যের পক্ষে, নাকি শুধু বিক্রির খাতিরে সংবাদ নামক পণ্যের? এই প্রশ্নের উত্তরই নির্ধারণ করবে, আমাদের গণমাধ্যম কোন পথে হাঁটবে; হলুদ সাংবাদিকতার বিভ্রান্তি না দায়বদ্ধ সাংবাদিকতার দীপ্ত আলোয়।

আরও পড়ুন