বৃহস্পতিবার ৩১ জুলাই, ২০২৫

সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের অংশে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা নিঃসন্দেহে বন বিভাগের জন্য একটি ইতিবাচক খবর। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ক্যামেরা ট্র্যাপিং জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি থেকে বেড়ে ১২৫টিতে দাঁড়িয়েছে। বন বিভাগ এই সফলতার কৃতিত্ব দিচ্ছে বিভিন্ন কার্যকর প্রকল্প, নিরাপত্তা জোরদারকরণ এবং বাঘ শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানকে।

বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪টি। পাঁচ বছর পর ২০২৩ সালে পরিচালিত ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতির জরিপে সেই সংখ্যা বেড়েছে ১১টি, অর্থাৎ প্রায় ১০ শতাংশ। এই বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে বাঘ সংরক্ষণে গৃহীত পদক্ষেপের ফল।

তবে স্বস্তির মাঝেও রয়েছেন কিছু উদ্বেগ। বিশেষজ্ঞরা বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি এর সুরক্ষা, প্রজনন সক্ষমতা বৃদ্ধি, এবং বাঘের শিকার প্রাণীর সংখ্যা বাড়ানোসহ সার্বিক নিরাপত্তায় বন বিভাগকে আরও মনোযোগী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।

সুন্দরবনের এই সাফল্যের উল্টো পিঠে রয়েছে এক করুণ চিত্র। জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে গত ২৫ বছরে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ৪২৫ জন মানুষ, আহত হয়েছেন আরও ৯৫ জন। বৈধ বা অবৈধভাবে বনজ সম্পদ আহরণ করতে গিয়ে এসব মানুষের জীবন থেমে গেছে বাঘের থাবায়।

শরণখোলার মো. আব্দুস সামাদ হাওলাদারের মতো অনেকেই এখনো সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার সাক্ষী। আড়াই দশক আগে কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে দুই চোখ হারিয়েছেন তিনি। সঙ্গীদের দ্রুত হস্তক্ষেপে সেদিন প্রাণে বাঁচলেও, সেই ক্ষত তার সারা জীবনের সঙ্গী।

২০২৩ সালের ১লা অক্টোবর এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হন ২২ বছর বয়সী শিপার হাওলাদার। মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান তিনি। চার দিন পর তার বিচ্ছিন্ন মাথা ও প্যান্ট উদ্ধার করা হয়। সরকারি অনুমতি ছাড়া বনে প্রবেশ করায় তার পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি, ফলে তার স্ত্রী, সন্তান এবং বৃদ্ধ বাবা-মা এখন অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।

বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে ক্ষতিপূরণ নীতিমালা কার্যকর হওয়ার পর থেকে আহত ও নিহতদের পরিবারকে মোট ৬৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, বাঘের আক্রমণে কেউ মারা গেলে ১ লাখ টাকা, আহত হলে ৫০ হাজার টাকা এবং বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হলে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

তবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ক্ষতিপূরণ প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল। এছাড়া নিয়মের জটিলতার কারণে অনেকেই এই ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বন সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা বাঘের আক্রমণে নিহত পরিবারের জন্য আজীবন মাসিক ভাতার দাবি জানিয়েছেন।

বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ জানিয়েছেন, বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব কমাতে ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন, ৭৪ কিলোমিটার বনের সীমানায় ফেন্সিংয়ের ৬০ কিলোমিটার সম্পন্নকরণ, জিরো টলারেন্স নীতি এবং বাঘের নিরাপত্তায় সুপেয় পানি ও আবাসস্থল তৈরির মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে বাঘ সুরক্ষা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা। সুন্দরবন রক্ষায় আমরা সংগঠনের সমন্বয়কারী নুর আলম শেখ বলেন, ২০১০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ১২ বছরে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করতে হবে। সেই হিসেবে বর্তমান বৃদ্ধি আশানুরূপ নয়।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, জলবায়ু পরিবর্তন, বিষ দিয়ে মাছ শিকার, এবং আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের তৎপরতা – সব মিলিয়ে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকিতে। তার মতে, এখনই সুরক্ষা জোরদার না করলে সুন্দরবন ও এর বন্যপ্রাণীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

আরও পড়ুন