
জীবন মানেই তো সংগ্রাম, আর সেই সংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার গল্পগুলো সব সময়ই অনুপ্রেরণা যোগায়। তেমনি এক সফলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মেহার গ্রামের যুবক রাসেল সরকার। মাত্র দুই লাখ টাকার পুঁজি নিয়ে শুরু করা একটি ছোট পোল্ট্রি ফার্ম আজ তাকে পঞ্চাশ লাখ টাকার মালিক বানিয়েছে। তার এই উত্থানের গল্প কেবল তার নিজের ভাগ্যবদল নয়, এলাকার বহু বেকার যুবকের জন্যও এক নতুন দিকনির্দেশনা।
গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে, একটা সময় ছিল যখন ভালো একটা চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে যুবকদের জীবনের মূল্যবান সময় কেটে যেতো। কিন্তু সেই চিরাচরিত ধারণা ভেঙে রাসেল সরকার প্রমাণ করেছেন, নিজ উদ্যোগে, সামান্য পুঁজি আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেও জীবনকে সম্পূর্ণ বদলে দেওয়া যায়। উচ্চশিক্ষা বা বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট নয়, বরং দূরদর্শিতা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিই যে সাফল্যের মূল চাবিকাঠি, তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।
রাসেল সরকারের শুরুটা কিন্তু মসৃণ ছিল না। গ্রামের অন্যান্য শিক্ষিত যুবকের মতোই চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিয়েছেন। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন, আর নয়, এবার তিনি নিজেই কিছু একটা করবেন। নিজের পৈত্রিক সামান্য জমিতে তার চোখ যায়। গবেষণা আর খোঁজখবর নিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, ক্রমবর্ধমান মাংস ও ডিমের চাহিদার বাজারে পোল্ট্রি ফার্ম একটি লাভজনক ব্যবসা হতে পারে। পরিবারের কাছ থেকে এবং কিছু ধার করে জোগাড় করলেন দুই লাখ টাকা। এই পুঁজি নিয়ে তিনি শুরু করেন তার স্বপ্নের পোল্ট্রি ফার্ম।
প্রথম দিকে, ছোট আকারের এই ফার্মে ছিল সীমিত সংখ্যক মুরগি। অভিজ্ঞতা কম থাকায় শুরুতে তাকে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। মুরগির রোগ, খাদ্যের মান এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব, নানা কারণে তাকে লোকসানও গুনতে হয়েছে। তবে রাসেল সরকার দমে যাননি। তিনি বিভিন্ন পোল্ট্রি ফার্মের মালিকের সাথে ফার্মের মুরগির বাচ্চার কোম্পানির লোকদের আলোচনা করে পোল্ট্রি পালনের আধুনিক কৌশলগুলো আয়ত্ত করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এই ব্যবসায় সফল হতে হলে সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপায়ে ফার্ম পরিচালনা করতে হবে।
এরপর তিনি ফার্মের অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটালেন। উন্নত জাতের মুরগি সংগ্রহ করলেন এবং তাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির দিকে বিশেষ নজর দিলেন। তার ফার্মে উন্নত ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হলো এবং সঠিক তাপমাত্রা বজায় রাখার কৌশল গ্রহণ করলেন। মুরগির খাদ্য হিসেবে তিনি নিজেই মানসম্মত মিশ্রণ তৈরি করতে শুরু করলেন, যা উৎপাদন খরচ কমাতেও সাহায্য করলো। তার এই আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনার ফল দ্রুতই আসতে শুরু করলো।
প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই তার ফার্ম থেকে শুধু ডিম বা মাংস নয়, একদিনের মুরগির বাচ্চাও বিক্রি হতে শুরু করলো। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে তিনি তার ফার্মের আকারও বাড়াতে লাগলেন। শুরুতে যে ফার্মে মাত্র ১০০০ মুরগি ছিল, এখন তা হাজার হাজার মুরগির বিশাল খামারে পরিণত হয়েছে। তার দুই লাখ টাকার মূলধন এখন আনুমানিক পঞ্চাশ লাখ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে, যা তার এই ব্যবসার অবিশ্বাস্য প্রবৃদ্ধি তুলে ধরে।
রাসেল সরকার এখন এলাকার একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত। তার ফার্মে এখন বেশ কয়েকজন স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তিনি বলেন, “চাকরির পেছনে না ছুটে যদি যুবকরা নিজেরা কিছু একটা করার উদ্যোগ নেয়, তবে সমাজে বেকারত্ব অনেক কমে যাবে। আমি তো শুধু একটা উদাহরণ, চাইলেই যে কেউ কঠোর পরিশ্রম আর সততা দিয়ে সফল হতে পারে।” তিনি তার এই সাফল্যের জন্য আধুনিক পদ্ধতি অবলম্বন এবং ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতাকে বড় করে দেখেন। মেহার গ্রামবাসীর কাছে রাসেল সরকার এখন এক অনুপ্রেরণার নাম, যিনি পোল্ট্রি ফার্মের মাধ্যমে কেবল নিজের ভাগ্যই নয়, এলাকার অর্থনৈতিক চিত্রও বদলে দিয়েছেন। তার এই গল্প হাজারো যুবককে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে উৎসাহিত করছে।
								
								







