
বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অব্যবস্থাপনা, অসচেতনতা, এবং পরিবহনজনিত কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশে উৎপাদিত খাদ্য পণ্যের গড়ে ৩৪ শতাংশ নষ্ট বা অপচয় হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, নষ্ট হওয়া এই বিপুল পরিমাণ খাদ্যের আর্থিক মূল্য দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশের সমান।
এই অপচয়ের বিপরীতে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ৬৬ শতাংশ মানুষ পর্যাপ্ত পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাবার পায় না বলেও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উৎপাদিত খাদ্যের ২৭ শতাংশই শেষ পর্যন্ত খাবার টেবিলে আসে না। এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সংরক্ষণে ঘাটতি, হিমাগারের স্বল্পতা এবং পরিবহনজনিত সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবকে। এই অব্যবস্থাপনার কারণে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
প্রতি বছর মোট আবাদ হওয়া জমির ২৭ শতাংশ বা ৩৪ হাজার বর্গকিলোমিটারে উৎপাদিত খাদ্য শেষ পর্যন্ত অপচয় হচ্ছে। গবেষণা বলছে, উৎপাদন, পরিবহন, পরিচালনা, সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের সময়ই বেশিরভাগ খাদ্য অপচয় হয়।
তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, খাদ্য অপচয়ের হার বিভিন্ন ফসলে ভিন্ন:
অন্যান্য ফসলের মধ্যে ধানের ২৩-২৮ শতাংশ, ফসল কাটার পরে গমের সাড়ে ১৭ শতাংশ, উদ্যানজাত ফসলের মধ্যে কলার ২০ শতাংশ, আলুর ২২ শতাংশ, গাজরের ২৭ শতাংশ, এবং টমেটোর ১০ শতাংশ অপচয় হচ্ছে।
এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও খাবার গ্রহণের সময়ে বাংলাদেশে একজন বছরে গড়ে ৮২ কেজি খাবার নষ্ট করে, যা যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ডস ও জাপানের মতো উন্নত দেশের চেয়েও বেশি। এই অপচয়ের কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক ক্ষতির মুখে পড়ছে।
গতকাল সোমবার ঢাকায় এক জাতীয় সম্মেলনে বিশ্ব ব্যাংকের এই গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), ঢাকায় অবস্থিত রয়েল ডেনিশ দূতাবাস, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক এবং বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি যৌথভাবে 'শূন্য খাদ্য অপচয়ের পথে: বাংলাদেশে একটি টেকসই খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা' শীর্ষক এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার সম্মেলনে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য অপচয় কমানোর ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, “আকর্ষণীয় প্রবৃদ্ধির পরও বাংলাদেশ এখনো অপুষ্টিতে ভুগছে, বিশেষ করে নারীরা। অন্যদিকে খাদ্য বণ্টন এখনো অসম। মাছের মধ্যে এক তৃতীয়াংশই অপচয় হচ্ছে। জেলেরা মাছ ধরার পর কখনো কখনো দুই তৃতীয়াংশই ফেলে দেয়, যা পরিবেশ দূষণ করে।”
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইয়াসিন বলেন, “খাদ্য অপচয়ের কারণে বাংলাদেশ মাটির উর্বরতা, অর্থ, পানি এবং শ্রম হারাচ্ছে। ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের জন্য কম খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে এবং তারা খাদ্য ঝুঁকিতে পড়ছে।”
ডেনমার্ক দূতাবাসের শার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ডার্স কার্লসেন বিশ্বব্যাপী খাদ্য অপচয়ের মাত্রা তুলে ধরে বলেন, “উৎপাদিত মোট খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশ নষ্ট বা অপচয় হয়। এই খাদ্য উৎপাদনের জন্য চীনের মত দেশের চেয়েও বড় আয়তনের জমি ব্যবহার করা হয়, যা শেষ পর্যন্ত কেউ খেতে পারে না।”
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার উপ-প্রতিনিধি দিয়া সানো ব্যাখ্যা করেন, বিশ্বে উৎপাদিত খাদ্য বৈশ্বিক জনসংখ্যার দেড়গুণের বেশি মানুষকে খাওয়ানোর জন্য যথেষ্ট হলেও, অসম বণ্টন, দুর্বল অবকাঠামো এবং খাদ্য অপচয়ের কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টি রয়ে গেছে।
বাংলাদেশে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির উপ-প্রধান জেসি উড জানান, “গবেষণা অনুযায়ী ফসল তোলার পর ৮-১৫ শতাংশ চাল এবং ২০-৪০ শতাংশ ফল ও সবজি নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য ২ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।” তিনি আরও বলেন, অপর্যাপ্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা এবং কোল্ড চেইনের অভাবে দেশীয় পণ্যই আমদানি করতে হয়, যা কৃষক এবং অর্থনীতির জন্য সুযোগের অপচয়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “যদি আমরা খাদ্য অপচয় বাড়াই, তাহলে আমরা দুর্লভ পরিবেশগত সম্পদ নিঃশেষ করছি। তাই আমাদের জন্য খাদ্য অপচয় কমানো অপরিহার্য।”
সম্পাদক : শাদমান আল আরবী | নির্বাহী সম্পাদক : তানভীর আল আরবী
ঠিকানা : ঝাউতলা, ১ম কান্দিরপাড়, কুমিল্লা-৩৫০০। ফোন : ০১৩১৬১৮৬৯৪০, ই-মেইল : [email protected], বিজ্ঞাপন: [email protected], নিউজরুম: [email protected] © ২০২৩ রাইজিং কুমিল্লা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Design & Developed by BDIGITIC