এপ্রিলের ১৪ তারিখ বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ। এই দিনটি বাংলাদেশের সবচাইতে বড় উৎসবগুলোর একটি। মুসলিম সম্প্রদায়ের দুইটি ঈদের পর পহেলা বৈশাখই দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ উদযাপন করে থাকেন। বাংলা বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হবে নতুন বাংলা বর্ষ ১৪৩০
গত তিন বছরে করোনাভাইরাসের কালো থাবায় সব রঙ হারিয়ে ফেলা ‘পহেলা বৈশাখ’, এবার আবার ফিরে পাচ্ছে তার রূপ-রঙ। বিবর্ণ নববর্ষের দুঃস্বপ্ন ভুলে পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ; ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৪২৯-কে নতুনের আবাহনে বরণ করবে বাঙালি জাতি। রমনা বটমূলে নতুন বছরের সূর্যকে ছায়ানটের শিল্পীরা সমবেত কণ্ঠে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো…’গানে স্বাগত জানিয়ে দিনের উৎসবের সূচনা করবে। জীর্ণ পুরাতন সবকিছু ভেসে যাক, ‘মুছে যাক গ্লানি’ এভাবে দিনভর নানা আয়োজনে রুদ্র বৈশাখকে বরণ করবে বাঙালি জাতি।
রাজধানী এবং সারাদেশ জুড়ে থাকবে বর্ষবরণের নানা আয়োজন। ‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩০’ জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদ্যাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। দিনটি সরকারি ছুটির দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে। ছায়ানট ভোরে রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।
কেবল বাংলাদেশ নয়, এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে ১৪ই এপ্রিলে নতুন বর্ষবরণের উৎসব পালন করা হয়। এর মধ্যে ভারতের কয়েকটি রাজ্য, মিয়ানমার, নেপাল, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনাম অন্যতম।
বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ উৎসবটিরও ইতিহাস আছে। পাকিস্তাানি শাসনামলে শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছুই করেছিল। একবার তো ওরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের উপরই নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসে। এর প্রতিবাদেই ছায়ানট ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানানো হয় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। আর ১৯৭২ সালে এটিকে জাতীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে।
পহেলা বৈশাখের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের আরেক আকর্ষণ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজিত হয় ১৯৮৯ সালে। এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের চারুকলা অনুষদ তখন ছিল চারুকলা ইনস্টিটিউট। সেই চারুকলা ইসস্টিটিউটের উদ্যোগে ও আয়োজনেই পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়। তারপর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার তা ফিরে আসে চারুকলায়। আর সে শোভাযাত্রায় রং-বেরঙের মুখোশে আর বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিমূর্তি দিয়ে একেক বছর তুলে ধরা হয় আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। একেক বছর এই শোভাযাত্রার জন্য একেক থিম বেছে নেওয়া হয়।
‘বাংলা নববর্ষ ১৪৩০’ উদ্যাপনে দেশজুড়ে আয়োজন
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। বাংলা নববর্ষে সকল কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার ও ইফতারের আয়োজন করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার এন্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগ দিনব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দিবসটি উদ্যাপন করবে।
রমজানে দেশের সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে। ছুটির মধ্যেও সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করতে হবে, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে।
১৪৩০ বাংলা সনকে বরণ করে নিতে মানুষের মধ্যে এবার ব্যাপক উন্মাদনা দেখা গেছে। নতুন বছরের প্রথম দিনটাতে নিজেকে সাজাতে কেনাকাটাও সেরে নিয়েছেন মানুষ।
নববর্ষ ঘিরে শহরে-গ্রামে-পথে-প্রান্তরে ‘বৈশাখী মেলা’র রেওয়াজ বহুকালের। গ্রাম বাংলার মানুষ সমস্বরে ‘মেলায় যাই রে’ গাইতে গাইতে ছুটে যান এসব মেলা। মেলায় নগরদোলা, হাওয়াই মিঠাই, মৃৎ-শিল্পের জিনিসপত্রের পসরায় নিজেকে নিয়ে যায় খাঁটি বাঙালির ঐতিহ্য-সংস্কৃতির শেকড়ে। বর্ষবরণে স্বাজাত্যবোধ এবং বাঙালিয়ানা নতুন করে প্রাণ পায়, উজ্জীবিত হয়। সার্বজনিন এ উৎসবে উন্মাদনা –উত্তাল আনন্দে মেতে উঠে তরুণ-তরুণী, শিশু-বয়োবৃদ্ধরাও।
বাংলা পঞ্জিকার নতুন সন ১৪৩০-এ বাঙালির জীবনে আনন্দধারা বয়ে আসুক। সঙ্কীর্ণতা, জীর্ণতা, অন্ধকার কালিমা মুছে গেয়ে উঠুক নতুনের জয়গান। মঙ্গলময় বার্তায় ছেয়ে যাক গোটা ধরণীতল, ভরে উঠুক সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধিতে – শুভ নবর্বষ।