২০২৩ সালের শেষে প্রিমিয়ার লিগের কিছু শীর্ষ খেলোয়াড়ের জন্য বছরটা মোটেই ভাল কাটেনি। বড় ট্রান্সফার মূল্যে নতুন ক্লাবে এসেও ফর্মহীনতায় ভোগার কারনেই এ সমস্ত খেলোয়াড়ের জন্য সময় যেন শেষই হচ্ছেনা। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দীর্ঘ ইনজুরিতে পড়ে পুরো বছরের জন্যই মাঠ থেকে ছিটকে গেছেন।
প্রিমিয়ার লিগে যে সমস্ত খেলোয়াড়দের জন্য ২০২৩ সালটা মোটেই ভাল কাটেনি তার একটি পরিসংখ্যান খোঁজার চেষ্টা করেছে ইএসপিএন।
তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো :
আন্দ্রে ওনানা (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) : ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এই গোলরক্ষকের জন্য বছরটা ছিল একেবারেই বিস্ময়কর। গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ইন্টার মিলানের হয়ে দারুন খেলার পর ৪৩.৮ মিলিয়ন পাউন্ডে ওল্ড ট্র্যাফোর্ড তাকে কিনে নেয়। ডেভিড ডি গিয়ার স্থলাভিষিক্ত হবার পর ওনানা একের পর এক বড় ভুল করে ইউনাইটেডকে ডুবিয়েছেন।
যে কারনে মৌসুমের প্রথম ভাগটা মোটেই ভাল কাটেনি ইউনাইটেডের। তবে কিছু সফলতাও রয়েছেন ওনান। এফসি কোপেনহেগেনর বিপক্ষে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে গ্রুপ পর্বে স্টপেজ টাইমে পেনাল্টি সেভ করে তিনি দলকে জয় উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু সব মিলিয়ে প্রিমিয়ার লিগের কোন গোলরক্ষকই ওনানার মত বছরজুড়ে এত ভুল করেননি।
রেসি জেমস (চেলসি) : চেলসির এই ডিফেন্ডার ইনজুরি ও অসুস্থতার কারনে এ বছর মাত্র সাতটি ম্যাচে খেলতে পেরেছেন। এক বছর আগে হাঁটুর ইনজুরির কারনে ইংল্যান্ডের হয়ে বিশ্বকাপও খেলা হয়নি। ফর্মহীনতায় বছর শেষে রেসির সামনে একটাই চ্যালেঞ্জ নতুন বছওে পুরোনো ফর্মে ফিরে আসা। ২৪ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডার গত এক বছরে ইনজুরি থেকে সেরে উঠতে না পারায় কোনভাবেই নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি।
অথচ নিজের সেরা সময়ে চেলসির প্রথম পছন্দের রাইট-ব্যাক ও অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক হ্যামস্ট্রিং ইনজুরিতে তিনি ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ছিটকে গেছেন।
এরিক ডায়ার (টটেনহ্যাম) : গত ডিসেম্বরে ডায়ার বিশ^কাপে ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন। কিন্তু এই এক বছরে টটেনহ্যামের হয়ে একটি ম্যাচও খেলতে পারেননি। নতুন ম্যানেজার আনগে পোস্তেকোগ্লুর অধীনে দুটি প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচে মাত্র একটিতে মূল দলে খেলেছেন ২৯ বছর বয়সী ডায়ার। অথচ মধ্যমাঠ ও রক্ষনভাগে সমানভাবে খেলার যোগ্যতা তার রয়েছে।
গত মৌসুমে প্রিমিয়ার লিগের ৩১টি ম্যাচে তিনি মূল দলে খেলেছেন। কিন্তু পোস্তেকোগ্লু স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন আনফিট ডায়ার তার পরিকল্পনায় নেই। যে কারনে ২০২৪ সালে তাকে ট্রান্সফারের ব্যপারে পোস্তেকোগ্লু আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
জাসকো গাভারডিওল (ম্যানচেস্টার সিটি) : ইউরোপের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ডিফেন্ডার হিসেবে গত গ্রীষ্মে জাসকো গাভারডিওলকে আরবি লিপজিগ থেকে ৭৭.৬ মিলিয়ণ পাউন্ডে দলে নিয়েছিল ম্যানচেস্টার সিটি। কিন্তু ক্রোয়েশিয়ান এই ডিফেন্ডার প্রিমিয়ার লিগের আবহের সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি।
নিয়মিত ভাবে সিটি বস পেপ গার্দিওলা তাকে লেফট-ব্যাক পজিশনে নির্বাচন করলেও নিজেকে মেলে ধরতে ব্যর্থ হন গাভারডিওল। একজন সেন্টার-ব্যাক হিসেবে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। কিন্তু রুবেন দিয়াস, ম্যানুয়েল আকাঞ্জি ও জন স্টোনস এই পজিশনে তার তুলনায় বেশ খানিকটা এগিয়ে রয়েছে। যে কারনে ইতিহাদ স্টেডিয়ামে ২১ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডারের শুরুটা মোটেই ভাল হলোনা।
মার্ক কুকুরেলা (চেলসি) : বার্সেলোনার সাবেক এই লেফট-ব্যাককে দলে পেতে ম্যানচেস্টার সিটি অনেক চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের আগস্টে সিটির দুটি প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়ে ব্রাইটন চেলসির কাছে কুকুরেলাকে ৬০ মিলিয়ন পাউন্ডে ছেড়ে দেয়। কিন্তু তারপর থেকে চেলসিতে কোন কিছুই কুকুরেলার পক্ষে যায়নি।
১৮ মাসের মাথায় স্ট্যামফোর্ড ব্রীজে তিনি এখন চতুর্থ ম্যানেজারের অধীনে রয়েছে। ২৫ বছর বয়সী এই ডিফেন্ডারের মান নিয়ে বর্তমান কোচ মরিসিও পোচেত্তিনো সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাথে সাম্প্রতিক পরাজয়ে কুকুরেলা রাইট-ব্যাক পজিশনে খেলেছেন, বিরতির পর অবশ্য বদলী বেঞ্চে চলে যান। আগস্টে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ধারে খেলতে যাবার বিষয়টি নাকচ করে দেয়া চেলসি।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে কুকুরেলা যে করেই হোক চেলসি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
এনজো ফার্নান্দেজ (চেলসি) : জানুয়ারিতে ১০৫ মিলিয়ন পাউন্ডে বেনফিকা থেকে চেলসিতে যোগ দেবার পর ফার্নান্দেজ প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে সবচেয়ে দামী খেলোয়াড়ের রেকর্ড গড়েন। তার এক মাস আগে কাতার বিশ^কাপে আর্জেন্টিনার শিরোপা জয়ে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু ২০২২ সালে রিভার প্লেট থেকে বেনফিকায় ৮.৮ মিলিয়ন পাউন্ডে যোগ দেবার পর চেলসির চোখ পড়ে তার উপর।
২২ বছর বয়সী এই আর্জেন্টাইনকে দলে ভেড়াতে সে কারনে ১০০ মিলিয়ন পাউন্ডের উপর ব্যয় করতে কার্পণ্য করেনি ব্লুজরা। তার প্রতিভা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু একের পর এক কোচ পরিবর্তনে চেলসিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে বিপাকে পড়েছেন।
কালভিন ফিলিপস (ম্যানচেস্টার সিটি) : ম্যানচেস্টার সিটির এই মিডফিল্ডার গত মৌসুমে মাত্র চারটি ম্যাচে মূল দলে খেলেছেন। যদিও তার দল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, এফএ কাপ ও প্রিমিয়ার লিগের শিরোপা জয়ের মাধ্যমে ট্রেবল জয়ের কৃতিত্ব দেখায়। এবারের মৌসুমে লিডসের সাবেক এই খেলোয়াড় সব প্রতিযোগিতায় মাত্র একটি ম্যাচে শুরু থেকেই দলে ছিলেন।
সিটিতে কোচ গার্দিওলাকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হওয়া ফিলিপস ইংল্যান্ড জাতীয় দলে পুরনো জায়গা ফিরে পেয়েছেন। ২০২৩ সালে কোচ গ্যারেথ সাউথগেটের অধীনে ছয়টি ম্যাচ খেলেছেন। এর মাধ্যমে ক্লাবের থেকে জাতীয় দলে বেশী ম্যাচ খেলার বিরল রেকর্ড গড়েছেন। জানুয়ারি ট্রান্সফার উইন্ডোকে সামনে রেখে গার্দিওলা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন নতুন ক্লাবের সন্ধানে ফিলিপস সিটি ছাড়ছেন।
ম্যাসন মাউন্ট (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) : গ্রীষ্মে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ইউনাইটেডে নাম লিখিয়েছিলেন মাউন্ট। ৫৫ মিলিয়ন পাউন্ডে তিনি চেলসি থেকে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে যোগ দেন। ২৪ বছর বয়সী এই মিডফিল্ডার এরিক টেন হাগের অধীনে সব ধরনের প্রতিযোগিতায় মাত্র আটটি ম্যাচে খেলেছেন। ইনজুরিতে পড়ার আগে মার্চে চেলসির হয়ে সর্বশেষ মূল দলে খেলেছিলেন। ফিটনেস সমস্যা ও ফর্মহীনতার কারনে ইংল্যান্ড জাতীয় দলের থেকে পুরো ২০২৩ সালও বাইরে ছিলেন।
এন্টনি (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) : এবারের মৌসুমে এখন পর্যন্ত এন্টনি কোন গোল বা এ্যাসিস্ট করেননি। আয়াক্স থেকে ২০২২ সালে আগস্টে ৮৫ মিলিয়ন পাউন্ডে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে তাকে নিয়ে আসাটা যে বড় ধরনের ভুল ছিল তা ইতোমধ্যেই প্রমান হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে বার্সেলোনার বিপক্ষে ইউরোপা লিগে দুর্দান্ত গোলই তার সর্বশেষ ও একমাত্র সাফল্য।
কিন্তু পুরো বছর জুড়ে প্রিমিয়ার লিগে তিনি মাত্র দুটি গোল ও দুটি এ্যাসিস্ট করেছেন। ব্রাজিলিয়ান এই খেলোয়াড়কে নিয়ে বেশ বিপাকেই আছে ইউনাইটেড।
মার্কাস রাশফোর্ড (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) : ২০২৩ সালে ১৬ ম্যাচে রাশফোর্ড ১৪ গোল করেছেন। তার নৈপুন্যে নিউক্যাসলকে ২-০ গোলে পরাজিত করে ক্যারাবাও কাপ জয়ের মাধ্যমে ছয় বছরের শিরোপা খরা কাটিয়েছে ইউনাইটেড। কিন্তু জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ঐ সাফল্যের পর ২৬ বছর বয়সী রাশফোর্ড বছর জুড়ে আর কোন সাফল্য উপহার দিতে পারেননি।
ক্যারাবাও কাপের পর ৪০ ম্যাচে করেছেন মাত্র ৮ গোল। একজন শীর্ষসারির স্ট্রাইকারের জন্য যা অত্যন্ত হতাশার।
মিখাইলো মাড্রিচ (চেলসি) : কুকুরেলা ও ফার্নান্দেজের মতই মাড্রিচকে বড় অঙ্কের বিনিময়ে দলে নেয়াটা চেলসির ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। জানুয়ারিতে তাকে নিয়ে আর্সেনাল বেশী আগ্রহী থাকলেও শেষ পর্যন্ত ৮৮ মিলিয়ন পাউন্ডে চেলসি ইউক্রেনিয়ান এই উইঙ্গারকে দলভূক্ত করে।
এরপর থেকে চেলসিতে তার সময়টা মোটেই ভাল যাচ্ছেনা। নতুন বছরে নিজেকে মেলে ধরতে না পারলে বিদায় নিশ্চিত হয়ে যাবে, এতে কোন সন্দেহ নেই।