জুন ১, ২০২৫

রবিবার ১ জুন, ২০২৫

পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নর শাসন: কেন্দ্রীয় ষড়যন্ত্র না সাংবিধানিক পদক্ষেপ

Rising Cumilla -Governor's rule in East Pakistan a central conspiracy or a constitutional measure
ছবি: সংগৃহীত

ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে পূর্ববাংলা (বর্তমান বাংলাদেশ) এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বারবার আলোচিত হয়েছে।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, দেশভাগ এবং পরবর্তী পাকিস্তানি শাসনামলে এই অঞ্চলের রাজনীতি ক্রমাগত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে।

এই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার এবং তার পতন একটি যুগান্তকারী অধ্যায় হয়ে রয়েছে। একদিকে এটি ছিল গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থানের প্রতীক, অন্যদিকে এর আকস্মিক পতন এবং গভর্নর শাসনের আরোপ ছিল গণতন্ত্রের ওপর এক সুস্পষ্ট আঘাত। এই আলোচনায় বিশ্লেষণ করবো কীভাবে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা মাত্র অল্প সময়েই ভেঙে পড়ে এবং কীভাবে পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ববাংলায় গভর্নর শাসন জারি করে, এবং এর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পরিণতি কী ছিল।

পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক বাস্তবতা

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তান নামে যে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তার দুটি অংশ, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান; ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক ভাবনায় ছিল একেবারেই ভিন্ন। পূর্ব বাংলার জনগণ শিগগিরই বুঝতে পারে যে পশ্চিম পাকিস্তান ভিত্তিক শাসকগোষ্ঠী পূর্বাঞ্চলের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। ভাষা আন্দোলন (১৯৪৮-১৯৫২) ছিল এর প্রথম বড় প্রমাণ।

এমন এক সময়, যখন পূর্ববাংলার মানুষ তাদের ভাষা ও অধিকার নিয়ে সোচ্চার, তখন পাকিস্তান মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমে আসছিল। এরই সুযোগে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো গড়ে তোলে যুক্তফ্রন্ট নামক জোট, যার অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন আবুল কাশেম ফজলুল হক (শেরে বাংলা একে ফজলুল হক) বাঙালি জাতীয়তাবাদের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।

যুক্তফ্রন্টের উত্থান ও মন্ত্রিসভা গঠন

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ৩০৯টি আসনের মধ্যে ২২৩টি আসন জয় করে এক অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করে। মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন পায়, যা জনগণের স্পষ্ট বার্তা বহন করে; পূর্ববাংলার মানুষ রাজনৈতিক পরিবর্তন চায়।

ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন, যাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ছিল; কৃষক শ্রমিক পার্টি, আওয়ামী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, বামপন্থী গণতন্ত্রী পার্টি ইত্যাদি। যুক্তফ্রন্ট তাদের ২১ দফা নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ভাষার অধিকার, কৃষি সংস্কার, শিক্ষা প্রসার, এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য রোধের কথা বলেছিল।

অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ

যদিও যুক্তফ্রন্ট বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে, তবে এর নেতৃত্বাধীন জোট ছিল মতাদর্শগতভাবে আলাদা ও কৌশলগতভাবে দুর্বল। ফজলুল হক ছিলেন অভিজ্ঞ কিন্তু বয়সজনিত কারণে দুর্বল; অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মওলানা ভাসানী এবং তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান আরও সক্রিয় রাজনৈতিক ভূমিকা চেয়েছিলেন।

এই বিভাজন ও সমন্বয়ের অভাবকে কাজে লাগায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার। পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক শাসকগোষ্ঠী কখনই চায়নি যে পূর্ব বাংলা নিজের পায়ে দাঁড়াক কিংবা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারুক। যুক্তফ্রন্ট সরকারের কিছু বক্তব্য ও সিদ্ধান্তকে ‘পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিপন্ন করার প্রয়াস’ হিসেবে উপস্থাপন করে তারা।

ফজলুল হক একসময় একটি বক্তৃতায় বলেন যে, “আমি পাকিস্তান কেমন হবে তা ১৯৪০ সালেই বলে দিয়েছিলাম।” এই উক্তিকে বিকৃত করে প্রচার করা হয় যে, তিনি পাকিস্তান ভেঙে দিতে চান। এই মিথ্যা অপ-প্রচারের ভিত্তিতে তাকে ‘পাকিস্তানবিরোধী’ ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার।

গভর্নর শাসন জারি: গণতন্ত্রের উপর আঘাত

মাত্র ৫৬ দিন পর, ১৯৫৪ সালের ৩০ মে, পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মালিক গুলাম মুহাম্মদ একটি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে গভর্নর শাসন জারি করেন। এই আদেশের পেছনে ছিল একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য; পূর্ববাংলায় গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান রোধ করা।

এই পদক্ষেপ ছিল সংবিধানবিরোধী ও জনমত উপেক্ষার সুস্পষ্ট উদাহরণ। একদিকে পূর্ববাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হলো, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বাঞ্চলকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রশাসনিক শক্তি প্রয়োগে দ্বিধা করলো না।

দীর্ঘমেয়াদে জাতীয়তাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদে ইন্ধন

গভর্নর শাসনের মাধ্যমে পূর্ববাংলার গণতন্ত্রকে যে উপেক্ষা করা হয়েছিল, তা গভীর ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি করে। জনগণ বুঝতে পারে, পাকিস্তানি রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে থেকে প্রকৃত গণতন্ত্র ও ন্যায্যতা পাওয়া কঠিন। এ ঘটনার পর রাজনৈতিকভাবে আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বাঙালি জাতীয়তাবাদী দলসমূহ।

১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে ১৯৫৪ সালের এই অভিজ্ঞতা এক গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

শেষ পরিণতি

ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা থেকে গভর্নর শাসনে উত্তরণ ছিল পাকিস্তানি শাসনের এক কালো অধ্যায়, যা বাঙালির রাজনৈতিক মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। একদিকে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা ও জন-আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে একনায়কতান্ত্রিক দমননীতি; এই দ্বন্দ্বের রূঢ় বাস্তবতাই এই ইতিহাসের মর্মবাণী।

এই রাজনৈতিক বিপর্যয় শুধু একটি সরকারের পতন ছিল না; এটি ছিল একটি জাতির স্বপ্নকে ভেঙে দেওয়ার প্রচেষ্টা, যা পরিণামে সেই জাতিকে স্বাধীনতার পথেই নিয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসের এ অধ্যায় আমাদের শেখায়, জনগণের রায় ও অধিকারকে উপেক্ষা করলে পরিণতি হয় সর্বনাশা।

আরও পড়ুন