
আরিফের বয়স মাত্র সাত। বয়স যত কম, কৌতূহল তত বেশি। প্রতিটি নতুন জিনিস তার চোখে বিস্ময় হয়ে ধরা দেয়, প্রতিটি শব্দ, দৃশ্য, গন্ধ যেন তাকে নতুন এক জগতে টেনে নিয়ে যায়।
এবারের কোরবানির ঈদ তার কাছে শুধু নতুন জামা, সেমাই কিংবা আতরের গন্ধের আনন্দ নয়—এবার সে বুঝতে শুরু করেছে ঈদের আরও গভীর মানে। সে টের পাচ্ছে, ঈদ মানে দায়িত্ব, আর কোরবানি মানে ত্যাগ।
এই বুঝের সূচনা হয়েছিল হঠাৎ করেই, এক দুপুরে। বাবা তখন বন্ধুদের সঙ্গে বসে গল্প করছিলেন। আরিফ দূরে বসে খেলনায় ব্যস্ত, কিন্তু তার কানে বাবার একটা কথা এসে ঠেকল—
“একটা ভালো গরু কিনতে হলে শুধু দাম না, চোখও ভালো থাকতে হয়।”
আরিফ থেমে গেল খেলায়। চোখ দিয়ে কীভাবে গরু চেনা যায়? এমন তো কেউ বলেনি আগে! সেই থেকেই মনে একটা প্রশ্ন জমে রইল—”ভালো গরু” চেনা কি সত্যিই এত কঠিন?
পরদিন সকালে সে তৈরি হয়ে বসে রইল। মাথায় মাফলার প্যাঁচানো, যা দেখতে অনেকটা পাগড়ির মতো। চোখে রোদচশমা—যদিও সেটা খেলনার, প্লাস্টিকের। কাঁধে ছোট একটা ব্যাগ, যেন সে-ই হাটের সবচেয়ে ব্যস্ত, সবচেয়ে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবাকে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আব্বু, আমি আজ হাটে যাবো। নিজে দেখে গরু পছন্দ করবো।”
বাবা প্রথমে চমকে তাকালেন। এরপর হালকা হেসে বললেন, “তুই পারবি হাটের ভিড় সামলাতে? গরুর গন্ধ, রোদ, মানুষের চেঁচামেচি?”
আরিফ চোখ বড় করে আত্মবিশ্বাসে বলল, “পারব! আমি চোখ দিয়েই বুঝে যাবো কোন গরু ভালো!”
বাবা একটু হাসলেন। এমন দৃঢ় উচ্চারণে না বলার উপায় ছিল না। মা চুপচাপ এসে ছেলের মাথায় একটা ছোট টুপি পরিয়ে দিয়ে শুধু বললেন, “খুব ভিড় হলে বাবার হাত ছাড়বি না।”
গরুর হাটে ঢোকার মুহূর্তটাই যেন এক বিস্ময়ের দরজা খুলে দিল আরিফের সামনে। এক ঝাঁক ধুলোমাখা বাতাস তার মুখে এসে লাগল, চারপাশে গরুর ডাক, শিকলের ঠকঠক শব্দ, মানুষের দরদামের কোলাহল—সব মিলিয়ে যেন কোনো জীবন্ত নাট্যমঞ্চ।
প্রথমে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিল আরিফ। এক বিশাল গরু হঠাৎ পাশ দিয়ে চলে গেল, তার গলায় গম্ভীর ডাক। আরিফ আঁকড়ে ধরল বাবার হাত।
“আব্বু, ওইটা হাতির মতো! এত বড়?”
বাবা হেসে বললেন, “ওটা শাহীওয়াল। বড় জাতের গরু। রাজা বলা যায়।”
আরিফ কৌতূহলী হয়ে বলল, “শাহীওয়াল মানে রাজার নাম?”
“হ্যাঁ, গরুর রাজাই ধর,” বাবা মৃদু হেসে বললেন।
তারা হাটে এগোতে থাকল। বিভিন্ন গরুর আকার, রঙ, ব্যবহার দেখে আরিফের চোখে নতুন এক দুনিয়া খুলে গেল।
এক জায়গায় তারা দেখল, এক লোক বাঁশি বাজাচ্ছে আর তার গরু শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। আরিফ অবাক হয়ে বলল, “আব্বু, গরুরও কি গান ভালো লাগে?”
বাবা বললেন, “ভালোবাসা তো সবাই চায় রে—মানুষ হোক বা গরু।”
সেই মুহূর্তে আরিফের মনে নতুন একটা ভাবনার জন্ম হল—এই গরুগুলোরও তো অনুভব আছে। ওরাও ভয় পায়, কষ্ট পায়। তারা কি বুঝতে পারে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে?
হঠাৎ হাটে হইচই শুরু হয়ে গেল। একটা ছোট কালো গরু দড়ি ছিঁড়ে দৌড়ে পালাল। লোকজন চিৎকার করে উঠল, কেউ দৌড়াচ্ছে পেছনে, কেউ ভয়ে সরে যাচ্ছে। সেই গরুটি একেবারে আরিফ আর তার বাবার সামনে দিয়ে ছুটে গেল।
আরিফ থমকে দাঁড়াল। তার চোখে সেই গরুর ভয়ার্ত দৃষ্টি এখনও ভাসছে।
সে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, “আব্বু, ও পালাতে চায় কেন?”
বাবা গভীর দৃষ্টিতে বললেন, “সবাইই তো বাঁচতে চায়। মানুষ হোক, গরু হোক।”
একটা শূন্যতা যেন আরিফকে ঘিরে ধরল। এতদিন সে ভাবত কোরবানি মানে ঈদের আনন্দ। আজ বুঝল, কোরবানি মানে জীবনের শেষ, মানে একটুখানি কান্না।
অনেক গরু দেখার পর, এক জায়গায় এসে তারা দাঁড়াল। মাঝারি আকারের লালচে এক গরু। চোখে আশ্চর্যরকম শান্তি। যেন কোনো অভিযোগ নেই, ভয় নেই, শুধু একটা জিজ্ঞাসা—“তুমি কে?”
আরিফ তাকিয়ে থাকল। গরুটিও তাকিয়ে রইল। যেন এক অদ্ভুত বন্ধন তৈরি হয়ে গেল।
আরিফ এগিয়ে গিয়ে গরুর গা ছুঁয়ে বলল, “তোমাকে আমরা বাসায় নিয়ে যাবো। আমি তোমার বন্ধু হবো।”
বাবা গরুটার সঙ্গে দরদাম করে তা কিনে ফেললেন। তারপর গরুর দড়িটা তুলে দিলেন আরিফের হাতে।
আরিফ গরুটিকে বলল, “ভয় পাস না। আমি থাকবো তো।”
রাস্তায় ফেরার সময় একটা মোটরসাইকেল এসে তাদের গরুর পাশে দাঁড়াল। পেছনে বসা একটা ছেলে বলল, “এই গরুটা তো সকালে আমার বাবা দেখতে এসেছিলেন। তোমরাই কিনে ফেললে নাকি?”
আরিফ গর্বে বলল, “হ্যাঁ! ও এখন আমার বন্ধু!”
ছেলেটি হাসল, চলে গেল। আরিফ বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “আব্বু, আমি না হলে তোমার গরুটা হাতছাড়া হতো!”
বাবা হেসে মাথায় হাত রাখলেন, “তুই না গেলে আমি কিছুই পারতাম না রে!”
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে আরিফ মাকে বলল, “মা, আজ আমি অনেক কিছু শিখেছি।”
“কি শিখলে বাবা?” মা জিজ্ঞাসা করলেন।
আরিফ বলল, “গরুরও মন আছে। আর ভালো গরু শুধু দেখতে না, বুঝতেও হয়। আমি বড় হয়ে গরু ডাক্তার হবো।”
মা হেসে বললেন, “তাই বুঝি?”
আরিফ চোখ মেলে চাঁদের আলোয় বলল, “হ্যাঁ। সবাই তো মানুষের ডাক্তার হয়। আমি গরুর মন বুঝব।”
বাতি নিভে গেল। ঘর অন্ধকার হয়ে এল। বাইরে হয়তো কোনো গরু শেষবারের মতো ডাকছে। আর আরিফ? তার চোখে ঘুম নেই।
তার আজকের অভিজ্ঞতা—মানুষ, গরু, সম্পর্ক, বন্ধুত্ব আর ত্যাগ—সব মিলিয়ে তাকে এক নতুন পৃথিবীর দরজায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
লেখক: রায়হানুল বারি রাসেল
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ,কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়