শুক্রবার ২১ নভেম্বর, ২০২৫

ঢাবির বিবিএ-এমবিএ শেষে কেঁচো সার উৎপাদনে সফল চান্দিনার আবু আমিন

ওসমান গনি, চান্দিনা, প্রতিনিধি

Rising Cumilla -Abu Amin of Chandina succeeds in producing earthworm fertilizer after completing BBA-MBA from DU
ঢাবির বিবিএ-এমবিএ শেষে কেঁচো সার উৎপাদনে সফল চান্দিনার আবু আমিন/ছবি: প্রতিনিধি

এক সময়ের কর্পোরেট জীবনের হাতছানি উপেক্ষা করে নিজ গ্রামে ফিরে মাটি ও প্রকৃতির সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেছেন কুমিল্লা চান্দিনা উপজেলার বারেরা ইউনিয়নের লোনাকান্দা গ্রামের আবু আমিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে ২০০৪ সালে ব্যবসায় প্রশাসনে (বিবিএ) ও ২০০৬ সালে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) ডিগ্রি অর্জন করে দেশের খ্যাতনামা বিভিন্ন টেলিকম কোম্পানিতে চাকরি করেও যেখানে মন বসেনি, সেখানেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন তাঁর আসল ঠিকানা। পুঁথিগত বিদ্যা আর পেশাগত জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ২০২৩ সালের শেষের দিকে তিনি শুরু করেন কেঁচো (ভার্মি কম্পোস্ট) সার উৎপাদনের এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ, যা আজ তাঁকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে।

আবু আমিনের এই পথচলা মোটেও মসৃণ ছিল না। বিলাসবহুল অফিস আর কর্পোরেট প্রোটোকলের জীবন ছেড়ে যখন তিনি গ্রামে ফিরে আসেন, তখন তার হাতে ছিল কেবল অদম্য ইচ্ছা আর সামান্য কিছু পুঁজি। কিন্তু নিজের মেধা আর শ্রমের ওপর ছিল তার অগাধ আস্থা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, দেশের কৃষি খাতে জৈব সারের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে এবং এখানেই লুকিয়ে আছে সফলতার বীজ। তাই দেরি না করে ২০২৩ সালের শেষের দিকে মাত্র ৫ হাজার পুঁজি নিয়ে খুব ছোট পরিসরে তিনি কেঁচো সার উৎপাদনের কারখানা শুরু করেন।

শুরুর দিকে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে এই সার সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে সারের গুণগত মান এবং এর ব্যবহারে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির ইতিবাচক ফল দেখে দ্রুতই কৃষকদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন আবু আমিন। তার কারখানায় উৎপাদিত উন্নত মানের এই জৈব সার বর্তমানে স্থানীয় কৃষকদের কাছে এক আস্থার নাম। কেঁচো সারের এই উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার নেই, যা মাটি ও পরিবেশের জন্য পুরোপুরি নিরাপদ।

বর্তমানে আবু আমিনের এই ছোট কারখানাটি কেবল একটি উৎপাদন কেন্দ্র নয়, এটি অনেক বেকার যুবকের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। কঠোর পরিশ্রম, সঠিক পরিকল্পনা এবং আধুনিক ব্যবস্থাপনার সমন্বয়ে তিনি তার কারখানাকে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছেন। বর্তমানে তাঁর কারখানাতে প্রতিমাসে প্রায় তিন মেট্রিক টন কেঁচো সার উৎপাদন হয়ে থাকে। এই পরিমাণ সার উৎপাদন করতে পারার সক্ষমতা প্রমাণ করে তার উদ্যোগটি কতটা সফল ও টেকসই হয়েছে।

মাত্র দুই থেকে আড়াই বছরের ব্যবধানে তার এই উদ্যোগ এখন লাভজনক। বর্তমানে তার মাসিক আয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা, যা দেশের খ্যাতনামা টেলিকম কোম্পানির চাকরির বেতনের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এবং একজন গ্রামীণ উদ্যোক্তার জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি সম্মানজনক আয়। এই আয় শুধু তার ব্যক্তিগত আর্থিক সচ্ছলতাই আনেনি, বরং তার পরিবার ও স্থানীয় অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

আবু আমিনের উৎপাদিত উন্নত মানের এই কেঁচো সারের চাহিদা শুধু চান্দিনা বা কুমিল্লাতেই সীমাবদ্ধ নেই। তার এই পরিবেশবান্ধব সার এখন পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলাতেও সরবরাহ করা হচ্ছে। কুমিল্লা ছাড়াও সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ফেনী সহ আরো অন্যান্য জেলায় নিয়মিতভাবে এই সার সরবরাহ হচ্ছে। এছাড়া, বর্তমান ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সুবিধা গ্রহণ করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক কৃষক ও কৃষি উদ্যোক্তা আবার অনলাইনে অর্ডার করেও তার উৎপাদিত সার সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। আবু আমিনের উৎপাদিত কেচো সার খুচরা ২০ থেকে ৩০ টাকা কেজি হিসেবে বিক্রি করা হয়। ্থানীয় কৃষকরা অহরহ সার নিয়ে থাকেন।

আবু আমিনের এই সফলতা প্রমাণ করে যে, উচ্চ শিক্ষা বা কর্পোরেট অভিজ্ঞতা কেবল রাজধানীতেই সফলতার চাবিকাঠি নয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মেধা ও উদ্যোগের মাধ্যমে সফল হওয়া সম্ভব। মাটির টানে ফিরে আসা এই ঢাবি গ্র্যাজুয়েট এখন অন্য সবার জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। চাকরির পিছু না ছুটে, নিজেই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে তিনি কেবল নিজের স্বপ্নই পূরণ করেননি, দেশের কৃষি উন্নয়নেও রাখছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তাঁর এই উদ্যোগ স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পাশাপাশি টেকসই কৃষি ব্যবস্থার দিকে আমাদের দেশকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

আবু আমিনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো তার এই উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়া এবং দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এই জৈব সার রপ্তানি করা। তিনি মনে করেন, সঠিক সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এবং জৈব সারের গুরুত্ব সম্পর্কে কৃষকদের মাঝে আরও সচেতনতা বাড়ানো গেলে এই খাতটি দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

আবু আমিনের কেঁচো সার সম্পর্কে জানতে চাইলে চান্দিনা উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মুহাম্মদ মোরশেদ আলম জানান, আমরা তাকে সার্বক্ষণিক বিভিন্নভাবে সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে থাকি। এবং সে আমাদের সহযোগিতায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তার ব্যবসার সম্প্রসারণ করতে আমরা সার্বক্ষণিকভাবে তাকে সহযোগিতা করে যাব।

আরও পড়ুন