কুমিল্লার চান্দিনা, দাউদকান্দি এবং চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলা জুড়ে বিস্তৃত ঘুগরার বিল (যা স্থানীয়ভাবে 'ঘুরঘার বিল' নামেও পরিচিত) শুধুমাত্র একটি জলভূমি নয়, এটি বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তিতে পরিণত হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা ধারণ করে।
প্রায় শত একর আয়তনের এই বিলটি তার বিশালতা, জীববৈচিত্র্য এবং কৃষিনির্ভর অর্থনীতির জন্য এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এক আশীর্বাদ। এর প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন সম্ভাবনাকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে এই অঞ্চল দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের এক নতুন মডেল হয়ে উঠতে পারে। বর্তমানে এই বিলের অর্থনীতি বহুলাংশে এর মৎস্য সম্পদ এবং কৃষিকাজের উপর নির্ভরশীল।
ঘুগরার বিলের অন্যতম প্রধান সম্পদ হলো এর অবিশ্বাস্য মাছ উৎপাদন ক্ষমতা। বর্ষা মৌসুমে বিলটি বিশাল জলরাশিতে পরিণত হয়, যা ৫০টিরও বেশি দেশি প্রজাতির মাছের প্রজনন ও বিচরণক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। দেশীয় রুই, কাতলা, মৃগেল, শোল, গজার, টেংরা, পুঁটি, এবং কৈ-এর মতো মাছের প্রাকৃতিক ভান্ডার এটি। এই বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদ শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রেই সহায়ক নয়, বরং হাজারো জেলে ও মৎস্যজীবীর জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। সারা বছর জুড়েই মাছ ধরা এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম প্রধান পেশা। সরকার যদি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বিলের প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সংরক্ষণ ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করে, তবে এটি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জাতীয় মৎস্য উৎপাদনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। মাছের অভয়াশ্রম তৈরি, বিল দূষণমুক্ত রাখা এবং স্থানীয় জেলেদের আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদান এই খাতকে আরও সুসংহত করতে পারে।
মৎস্যসম্পদের পাশাপাশি এই বিল কৃষি ও জলজ উদ্ভিদের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। শুষ্ক মৌসুমে বিলের কিছু অংশে ধানের ফলন হয়, যা স্থানীয় খাদ্য নিরাপত্তায় সরাসরি অবদান রাখে। তবে, বিলের বিশেষ আকর্ষণ হলো এর প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা লাল ও সাদা শাপলা। এই শাপলার প্রাচুর্য বিলের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়েছে, তেমনি শাপলা খাদ্য হিসেবেও ব্যবহৃত হয় এবং স্থানীয়দের জন্য অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ সৃষ্টি করে। এছাড়াও, বিভিন্ন প্রজাতির শৈবাল, কচুরিপানাসহ নানা জলজ উদ্ভিদ বিলটিতে বিদ্যমান। এই জলজ সম্পদকে ভিত্তি করে স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প যেমন হস্তশিল্প বা জৈব সার উৎপাদন উৎসাহিত করা যেতে পারে। বিলের পাড়ে গড়ে ওঠা গ্রামগুলোতে হাঁস পালনও একটি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক কার্যক্রম।
ঘুগরার বিলের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শাপলার দৃষ্টিনন্দন সমাহার একে এক আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। বর্ষা মৌসুমে এর দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি এবং জলজ উদ্ভিদের স্নিগ্ধতা দেখতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে আসা পর্যটকরা এখানে ভিড় করেন। বিলের লাল-সাদা শাপলার মায়াবী হাতছানি স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন আয়ের পথ তৈরি করেছে। বিলকে কেন্দ্র করে নৌকা ভ্রমণ, প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ এবং স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। পর্যটকদের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, মানসম্মত স্থানীয় খাবারের ব্যবস্থা এবং পরিবেশবান্ধব বিশ্রামাগার নির্মাণ করা হলে এটি একটি স্থায়ী ও লাভজনক পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটলে স্থানীয়ভাবে হোটেল, পরিবহন, গাইড এবং হস্তশিল্পের মতো সেবা খাতগুলো বিকশিত হবে, যা পুরো অঞ্চলের অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জাতীয় অর্থনীতিতে ঘুগরার বিলের ভূমিকা নিশ্চিত করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ ও টেকসই ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশবিদ এবং সাধারণ মানুষের অংশীদারিত্বে বিলটির জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। অপরিকল্পিতভাবে বিল ভরাট করে এর প্রাকৃতিক জলাধার নষ্ট করা বা রাসায়নিক বর্জ্য ফেলে দূষিত করার প্রবণতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। যদি বিলের মৎস্য, কৃষি ও পর্যটন সম্ভাবনাকে সমন্বিতভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে কুমিল্লার চান্দিনার এই ঘুগরার বিল কেবল স্থানীয় অর্থনীতির গণ্ডি পেরিয়ে দেশের সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তিতে পরিণত হবে। এই প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা ও উন্নত করার মাধ্যমে এটি গ্রামীণ উন্নয়নে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
সম্পাদক : শাদমান আল আরবী | নির্বাহী সম্পাদক : তানভীর আল আরবী
ঠিকানা : ঝাউতলা, ১ম কান্দিরপাড়, কুমিল্লা-৩৫০০। ফোন : ০১৩১৬১৮৬৯৪০, ই-মেইল : [email protected], বিজ্ঞাপন: [email protected], নিউজরুম: [email protected] © ২০২৩ রাইজিং কুমিল্লা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Design & Developed by BDIGITIC