
ওসমান গনি, চান্দিনা প্রতিনিধি:
একটি বাড়ির আঙিনা কত বড় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ স্থাপন করেছেন কুমিল্লায় চান্দিনা উপজেলার মেহার গ্রামের উদ্যমী কৃষক মানিক মিয়া। গতানুগতিক কৃষির সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে তিনি তার বসতভিটার পতিত ও অব্যবহৃত জমিতে একইসঙ্গে আদা ও পেঁপের সাথী ফসল চাষ করে এবার কেবল চোখ ধাঁধানো বাম্পার ফলনই পাননি, বরং তা দিয়ে পুরো পরিবারে এনেছেন আর্থিক সচ্ছলতা ও স্বনির্ভরতা। তার এই উদ্যোগ প্রমাণ করে, সামান্য জমি এবং সঠিক কৃষি জ্ঞান কাজে লাগিয়েও বড় সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।
মানিক মিয়া প্রথমে তার বাড়ির পাশের উঁচু ভিটায় উন্নত জাতের পেঁপের চারা রোপণ করেন। চারাগুলো একটু বড় হওয়ার পর তিনি পেঁপে গাছের সারির মাঝের ফাঁকা স্থানগুলোতে আদার বীজ বা কন্দ রোপণ করেন। কৃষিবিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতিকে ‘সাথী ফসল চাষ’ হিসেবে অভিহিত করেন, যা একই জমিতে একাধিক ফসল ফলিয়ে জমির সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করে এবং কৃষকের আয় বহুলাংশে বাড়িয়ে দেয়। মানিক মিয়ার এই কৌশল ছিল অত্যন্ত সুচিন্তিত ও বিজ্ঞানসম্মত।
মানিক মিয়া জানান, এই দুটি ফসল নির্বাচনের পেছনে ছিল সুচিন্তিত পরিকল্পনা। পেঁপে একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল, যা একবার রোপণ করলে ১৮ মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত ফলন দেয়। অন্যদিকে, আদা একটি কন্দজাতীয় মসলা ফসল, যা মাটির নিচে জন্মায় এবং সাধারণত ৯-১০ মাসের মধ্যে তোলার উপযুক্ত হয়। পেঁপে গাছ যখন ছোট থাকে, তখন আদা গাছ পর্যাপ্ত সূর্যালোক ও বাতাস পায় এবং দ্রুত বাড়ে। এতে আদার ফলনে কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। আবার পেঁপে গাছ বড় হয়ে ছায়া তৈরি করলেও আদা মাটির নিচের ফসল হওয়ায় তাতে কোনো অসুবিধা হয় না। এই কৌশলগত বিন্যাস নিশ্চিত করেছে যে, কোনো ফসলই একে অপরের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করেনি, বরং জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন, সূর্যের আলো, পানি ও পুষ্টির সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হয়েছে। এ যেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এক অপূর্ব মেলবন্ধন, যেখানে প্রতিটি ইঞ্চি জমির মূল্য সুনিশ্চিত করা হয়েছে। একক ফসল চাষের তুলনায় এই পদ্ধতিতে মাটির উর্বরতাও বজায় থাকে বলে তিনি মনে করেন।
মানিক মিয়া তার এই বিশেষ বাগানের প্রতি দিয়েছেন বিশেষ মনোযোগ এবং পরিশ্রম। তিনি মূলত জৈব সারের ওপর জোর দিয়েছেন, কারণ এটি মাটির উর্বরতা বাড়াতে এবং ফসলের গুণগত মান ধরে রাখতে সাহায্য করে। সঠিক সময়ে পরিমাণমতো গোবর সার, কম্পোস্ট এবং প্রয়োজন অনুসারে সীমিত পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল নিয়মিত আগাছা পরিষ্কার এবং রোগবালাই দমন। যেহেতু দুটি ফসল একই জায়গায় চাষ হচ্ছে, তাই রোগ বা পোকামাকড়ের আক্রমণ যেন এক ফসল থেকে অন্য ফসলে দ্রুত না ছড়ায়, সেদিকে তিনি সবসময় সতর্ক ছিলেন। সময়মতো সেচ দেওয়া এবং বর্ষার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখায় ফসলের ক্ষতি হয়নি বললেই চলে।
তার এই নিবিড় পরিচর্যার ফল মিলেছে হাতেনাতে। প্রতিটি পেঁপে গাছ এখন ফলন্ত পেঁপেতে ভরে গেছে। গাছে এখন পেঁপে ঝুলছে। কাঁচা ও পাকা পেঁপে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে তিনি ইতোমধ্যে মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জন করেছেন। ফলন এতটাই বেশি হয়েছে যে, এই পেঁপে বিক্রি করেই তার প্রাথমিক চাষের খরচ উঠে এসেছে এবং পরিবারে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে। অন্যদিকে, সদ্য মাটির নিচ থেকে তোলা সুঘ্রাণযুক্ত আদার ফলনও হয়েছে বাম্পার। মানিক মিয়া তার বাগানে একসাথে ফলানো আদা ও পেঁপে নিজের পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে আত্মীয় স্বজনকে দিচ্ছেন।
মানিক মিয়ার এই সফলতা কেবল তার আর্থিক ভাগ্যই পরিবর্তন করেনি, বরং তা মেহার গ্রামের অন্যান্য ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্যও আশার আলো দেখিয়েছে। গ্রামের বহু কৃষক, যারা এত দিন শুধু ধান বা অন্যান্য একক ফসলের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন এবং লোকসান গুনছিলেন, তারা এখন মানিক মিয়ার কাছে এসে এই সাথী ফসল চাষের পদ্ধতি জানতে চাইছেন। মানিক মিয়াও নির্দ্বিধায় তার সব কৌশল ও অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছেন। অনেকে আবার ছোট পরিসরে হলেও আদা ও পেঁপের পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করে দিয়েছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন, ছোট হলেও প্রতিটি ইঞ্চি জমিই অত্যন্ত মূল্যবান, যদি তা সঠিক উপায়ে ব্যবহার করা যায়।
মানিক মিয়ার ভাষ্যমতে, “আমি বড় কৃষক নই। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ছোট জায়গায় যদি স্মার্ট উপায়ে চাষ করা যায়, তবে ভালো লাভ করা সম্ভব।আমি যখন আদা ও পেঁপে একসঙ্গে লাগালাম, তখন মনে একটু ভয় ছিল। কিন্তু এখনকার বাম্পার ফলন দেখে আমার সব ভয় কেটে গেছে। আমার এই সামান্য উদ্যোগ দেখে গ্রামের আরও কয়েকজন ভাই চাষ শুরু করেছেন। আমি চাই, শুধু আমার নয়, সবার ঘরেই যেন এই সবুজ বিপ্লবের ছোঁয়া লাগে।” তার এই সফলতা গ্রামীণ অর্থনীতিতে এক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
এলাকার মানুষ মানিক মিয়ার এই উদ্যোগকে ‘সময়োপযোগী ও আধুনিক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা বলেছেন, মানিক মিয়ার মতো উদ্যমী কৃষকদের মাধ্যমেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, মিশ্র চাষ বা সাথী ফসল পদ্ধতি কেবল পরিবেশবান্ধবই নয়, এটি চরম লাভজনকও। এতে মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং কৃষকের ঝুঁকি কমে। এলাকার লোকজন মনে করেন, অন্য কৃষকদের মাঝেও এই পদ্ধতি ছড়িয়ে দিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে দেয়া উচিত। যাতে আরও বেশি সংখ্যক কৃষক এই লাভজনক পদ্ধতিতে চাষে আগ্রহী হন।
মানিক মিয়া এখন তার এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পেঁপে ও আদা চাষের পাশাপাশি অন্যান্য সাথী ফসল যেমন, কচু, হলুদ ও লেবুর মিশ্র চাষের দিকে ঝুঁকতে চান। তার স্বপ্ন, গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনা যেন এভাবে ফসলের ক্ষেতে পরিণত হয়ে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করে তোলে। মানিক মিয়ার বাড়ির আঙিনায় শুরু হওয়া এই ছোট বিপ্লব এখন চান্দিনার কৃষিতে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে এবং গ্রামীণ সচ্ছলতার এক নতুন পথ দেখাচ্ছে।