জুন ১৭, ২০২৫

মঙ্গলবার ১৭ জুন, ২০২৫

চরাঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ‘কাউন’

কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলে এখনও কিছু জমিতে দেখা মিলছে বিলুপ্তপ্রায় কাউনের/ ইউএনবি

একসময় কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হিসেবে পরিচিত কাউন (ফক্সটেল মিলেট) এখন বিলুপ্তির পথে। পুষ্টিকর ও খরা সহনশীল এই ফসলটি শতাব্দী ধরে চরের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও, বর্তমানে অধিক লাভজনক ফসলের দিকে কৃষকদের ঝুঁকে পড়ার কারণে এর আবাদ আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে।

কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে জেলায় মাত্র ৬০ হেক্টর জমিতে কাউনের চাষ হচ্ছে, যা গত বছর ছিল ৪২০ হেক্টর। দুই দশক আগেও প্রায় ২০ হাজার হেক্টর জমিতে কাউনের আবাদ হতো। একসময় চরের মাঠে যে সোনালি কাউনের ঢেউ খেলত, সেখানে এখন শোভা পাচ্ছে ধান, ভুট্টা ও মিষ্টি কুমড়ার মতো বাণিজ্যিক ফসল।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কুড়িগ্রামের উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ইউএনবিকে জানান, “বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে এক দশকের মধ্যেই চরাঞ্চল থেকে কাউন চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। এটি শুধু ফসলের বৈচিত্র্যের পরিবর্তন নয়, বরং একটি গ্রামীণ খাদ্য ঐতিহ্যের অবক্ষয়।”

কাউন চাষে কৃষকদের অনাগ্রহের মূল কারণ হলো লাভ কমে যাওয়া। নাগেশ্বরীর চর বামনডাঙ্গার কৃষক নজরুল ইসলাম (৬৫) বলেন, “গত বছর পাঁচ বিঘা জমিতে কাউন চাষ করে লোকসান গুনেছি, তাই এবার মাত্র এক বিঘায় করেছি। প্রতি বিঘা থেকে ৪-৬ মণ কাউন পাওয়া যায়, যা মণপ্রতি ১,২০০ থেকে ১,৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় আড়াই হাজার টাকা। এতে কৃষকদের পোষায় না।”

বাড়তি উৎপাদন খরচ, শ্রমিক সংকট এবং ভোক্তাদের রুচির পরিবর্তনও কাউন চাষে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কুড়িগ্রাম সদরের চর ত্রাপুরের কৃষক বদিয়ার রহমান (৭৭) জানান, “আগে বন্যার কারণে ধান না হলে কাউনই ছিল আমাদের প্রধান খাদ্য। এখন হাইব্রিড ধান ও ভুট্টা ভালো হয়, আর কেউ কাউনের ভাত খেতে চায় না।”

তবে, মানুষের খাদ্যতালিকা থেকে হারিয়ে গেলেও, কাউন এখন পাখির খাবার হিসেবে নতুন পরিচিতি লাভ করেছে। চিলমারীর জোড়গাছ বাজারের ব্যবসায়ী মমতাজ আলী বলেন, “আমি কৃষকদের কাছ থেকে কাউন কিনে ঢাকার পাখির বাজারে পাঠাই। এখন পাখিপ্রেমীরাই কাউনের বড় ক্রেতা।” তার মতে, একসময়ের নিত্যপ্রয়োজনীয় শস্যটি এখন সংস্কৃতি ও অর্থনীতির দিক থেকে একটি প্রান্তিক পণ্যে পরিণত হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রংপুর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক শফিকুল ইসলাম মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময়ে কাউনের মতো খরাসহনশীল ও কম খরচের ফসল অত্যন্ত জরুরি। তিনি বলেন, “সরকারি উদ্যোগ ও বাজার উৎসাহ না থাকলে কৃষকরা এই ফসল টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী হবেন না।”

আরও পড়ুন