জুন ৪, ২০২৫

বুধবার ৪ জুন, ২০২৫

ঘাটতির ছায়া ও উন্নয়নের প্রত্যয়: বাংলাদেশের বাজেট যাত্রার ৫৪ বছর

Rising Cumilla -Shadow of Deficit and Promise of Development 54 Years of Bangladesh's Budget Journey
ছবি: রাইজিং কুমিল্লা

সবকিছু ঠিক থাকলে আজ সোমবার (২ জুন) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর (৯ম) ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কর্তৃক ঘোষিত হতে যাচ্ছে, বাংলাদেশের ৫৪ তম জাতীয় বাজেট।

বাংলাদেশের ইতিহাসে বাজেট একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ৫৩টি বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে (২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত)। প্রতিটি বাজেটই ছিল এক একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি।

কখনো প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যাশার সমাহার, কখনো সংকট ও স্থিতিশীলতার চিত্র, আবার কখনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত। এই দীর্ঘযাত্রায় বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থাপনা এবং অর্থনৈতিক কৌশলের যেমন পরিবর্তন হয়েছে, তেমনি বাজেট ঘিরে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাও ক্রমাগত রূপান্তরিত হয়েছে।

স্বাধীনতার পর প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন। বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা, যেখানে তৎকালীন প্রাধান্য ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন, কৃষি ও শিল্প পুনরুজ্জীবন এবং খাদ্য নিরাপত্তা।

পরবর্তী সময়গুলোতে বাজেট ক্রমাগত পরিধি ও প্রভাবে বেড়েছে, যেমন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা—যা প্রথম বাজেটের তুলনায় প্রায় ১০,০০০ গুণ বেশি।

বাংলাদেশের বাজেটের এই দীর্ঘ ইতিহাসকে সাধারণভাবে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়: প্রাথমিক পুনর্গঠন ও রাষ্ট্রগঠনের যুগ (১৯৭২–১৯৮০), কাঠামোগত সমন্বয় ও উদারীকরণের যুগ (১৯৮১–২০০০), এবং আধুনিক অর্থনৈতিক রূপান্তর ও উন্নয়ন পরিকল্পনার যুগ (২০০১–বর্তমান)। প্রতিটি যুগের বাজেটই তার নিজস্ব প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতায় প্রভাবিত হয়েছে।

প্রথম দশক ছিল অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সময়। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীলতা, বৈদেশিক অনুদানের গুরুত্ব, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের প্রসার এবং বৃহৎ সরকারি বিনিয়োগ এই সময়ের বাজেটের বৈশিষ্ট্য ছিল।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। বাজেটে রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা ছিল অত্যন্ত দুর্বল, ফলে বৈদেশিক অনুদান ও ঋণের ওপর নির্ভরতা ছিল প্রবল।

১৯৮০ এর দশক থেকে বাজেটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ও বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সমন্বয় নীতির প্রতিফলন দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় ব্যয় হ্রাস, বেসরকারিকরণ, শিল্প খাতে বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন ও বাণিজ্য উদারীকরণ প্রাধান্য পেতে শুরু করে।

এই সময় থেকেই বাজেটে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং মূল্য সংযোজন কর (VAT) চালু করার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। ১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান প্রথমবারের মতো ভ্যাট চালু করেন এবং বাজেটে বাজারমুখী অর্থনীতির সূচনা ঘটে। একই সময়ে সামাজিক খাতে, বিশেষত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়তে শুরু করে।

২০০০ এর দশকে এসে বাজেট নতুন মাত্রা পেতে শুরু করে। তৎকালীন সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যয় নিয়ে বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি যেমন বৃদ্ধভাতা, বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ইত্যাদি চালু হয়।

এসময় থেকেই বাজেট ঘিরে ব্যাপক গণমাধ্যম কভারেজ শুরু হয় এবং বাজেট জনমানুষের আলোচনার কেন্দ্রে আসে। বাজেট শুধু সংখ্যার খেলা না হয়ে রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং নীতিনির্ধারণের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে।

২০২০ এর পরবর্তী সময় ছিল কোভিড-১৯ মহামারিজনিত আর্থিক অচলাবস্থার সাথে মোকাবেলার বাজেট। সরকার তখন স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ায়, একইসাথে প্রণোদনা প্যাকেজ ও খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিকে রক্ষা করার চেষ্টা করে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ছিল সংকট মোকাবেলার বাজেট।

সাম্প্রতিক বাজেটগুলোতে বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন, রূপকল্প ২০৪১ এবং স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণা, কর সংস্কার, বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনা, এবং জলবায়ু সহনশীল বাজেট প্রণয়নের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

একইসাথে, বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ক্রমাগত বাড়ানো হয়েছে এবং এ খাতে বৈদেশিক সহায়তার ব্যবহারও বেড়েছে।

তবে বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থার কিছু চিরাচরিত সমস্যা রয়েছে — যেমন: বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধীরগতি, বাজেট বাস্তবায়নে তদারকির অভাব, কর-জিডিপি অনুপাতের নিম্নস্তর (যা এখনো ৯-১০ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে), কর ফাঁকি, এবং ঘাটতি বাজেটের উপর নির্ভরতা। এছাড়া, বাজেটে প্রায়ই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বছরের শেষে সেগুলোর অনেকাংশই অর্জিত হয়নি।

একই সাথে, রাজস্ব আয় সংগ্রহে এখনও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর ওপর একচ্ছত্র নির্ভরতা, কর কাঠামোর জটিলতা, এবং প্রত্যক্ষ করের তুলনায় পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরতা সামাজিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে তোলে। বাজেট কখনো কখনো রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের প্রতিফলনও বয়ে আনে, যেখানে নির্বাচনী বছরে জনমুখী বরাদ্দ বৃদ্ধি পায়।

তবে, উল্লেখযোগ্য যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেট প্রণয়নে স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজেট প্রস্তুতির আগে বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গে আলোচনা, সিটি কর্পোরেশন ও জেলা পর্যায়ে বাজেট শুনানির আয়োজন এবং অনলাইনে বাজেট ডকুমেন্ট প্রকাশ একটি উন্নততর দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশের প্রথম ৫৩টি বাজেট তাই শুধু সংখ্যার দলিল নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক নীতিমালার পরিবর্তনের রূপরেখা। এই বাজেটগুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে যুদ্ধের পরবর্তী ধ্বংসাবশেষ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস, গণতন্ত্রের উত্তরণ, অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম, দারিদ্র্য হ্রাসের অভাবনীয় অগ্রগতি এবং ভবিষ্যতের উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন।

তাই বাজেট কেবল অর্থ মন্ত্রীর/উপদেষ্টার ভাষণ নয়, এটি হলো দেশের সামগ্রিক অগ্রযাত্রার দিক-নির্দেশনা। ৫৩ বছরের বাজেট ইতিহাস আমাদের শেখায়; যথাযথ পরিকল্পনা, দক্ষ বাস্তবায়ন এবং জনসম্পৃক্ততা ছাড়া বাজেটের সাফল্য সম্ভব নয়।

অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের বাজেটগুলো হতে পারে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই ও কর্মমুখী; যেখানে প্রতিটি নাগরিক নিজেকে এই অর্থনৈতিক নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখতে পান।

আরও পড়ুন