শীতকাল মানেই প্রকৃতিতে এক ভিন্ন রূপ। বাংলার গ্রামীণ জনপদে শীত শুধু ঋতু নয়, এটি এক আনন্দময় উৎসবের সময়। শীতের আমেজে ভরপুর এই সময়টিতে গ্রামের মানুষের জীবনে যোগ হয় নতুন প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু কালের বিবর্তনে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় শীত উৎসবের অনেক কিছুই বদলে গেছে।
অতীতের ঐতিহ্য আর বর্তমানের বাস্তবতা মিলিয়ে বাংলার শীত উৎসব নিয়ে আমাদের ভাবনা গভীরতর। গ্রামীণ বাংলার শীতকাল মানে ছিল কাজের ফাঁকে আনন্দে মেতে ওঠা। ফসল তোলা, গৃহস্থালির কাজ শেষ করে শীতের রাতগুলো কাটত গল্প, গান, আর নানা ধরনের উৎসবে। 'নবান্ন' ছিল শীতের এক বড় উৎসব। নতুন ধান কাটা, মাড়াই, এবং সেই ধান থেকে চিঁড়া-মুড়ি তৈরি করে গ্রামে গ্রামে নবান্নের আয়োজন ছিল সাধারণ দৃশ্য।
শীতের সকাল মানেই ছিল পিঠা-পুলি বানানোর ধুম। নারীরা ঘরোয়া পরিবেশে চালের গুঁড়া, গুড় আর নারকেল দিয়ে তৈরি করত ভাপা, পাটি সাপটা, সেমাই পিঠা। গ্রামীণ বাংলার মেয়েদের এই পিঠা বানানো ছিল এক ধরনের শিল্প। সন্ধ্যা হলে পিঠার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত পুরো গ্রামে।
এছাড়া, শীতের রাতে 'জারি-সারি' গান বা 'পালাগান' ছিল বিনোদনের প্রধান উৎস। খোলা মাঠে, আগুন জ্বালিয়ে, মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান শুনত। স্থানীয় মেলায় পুতুল নাচ, বায়োস্কোপ, আর মাটির খেলনা কেনার আনন্দ ছিল সীমাহীন। শীতের দিনগুলোতে কুঁড়েঘরে কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে লুঙ্গি বা চাদরে জড়ানো মানুষেরা চায়ের দোকানে জড়ো হয়ে আড্ডায় মেতে উঠত। শীতের রাতে শীতবস্ত্র হিসেবে লেপ-কাঁথা তৈরির ধুমও ছিল উল্লেখযোগ্য।
অতীতের তুলনায় গ্রামীণ বাংলার শীত উৎসবে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আধুনিক প্রযুক্তি এবং নাগরিক জীবনের প্রভাব গ্রামে প্রবেশ করায় ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। বর্তমানে গ্রামে নবান্ন উদযাপনের প্রবণতা কমে গেছে। যান্ত্রিক কৃষির আগমনে ধান কাটার সময়ও নির্দিষ্ট থাকে না। ফলে নতুন ফসলের আনন্দ ভাগাভাগি করার ঐতিহ্যও হ্রাস পেয়েছে।
[caption id="attachment_29631" align="alignnone" width="1200"] গ্রামীণ বাংলার শীত উৎসব: অতীত ও বর্তমান | লেখক[/caption]
পিঠা-পুলির সেই ঐতিহ্য এখনও কিছুটা টিকে থাকলেও, এর ব্যাপকতা কমে গেছে। ব্যস্ত জীবনে নারীদের হাতে তৈরি পিঠার জায়গায় আধুনিক যন্ত্র বা দোকানের পিঠা স্থান দখল করেছে। শহরের মানুষ শীতের পিঠা নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান করলেও গ্রামে এই চর্চা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। আগে মেলা ছিল গ্রামের বড় বিনোদন। এখন টেলিভিশন, স্মার্টফোন, এবং ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে মেলার গুরুত্ব কমে গেছে। যেসব মেলা এখনও আয়োজিত হয়, সেখানে আধুনিক খেলনা বা চীনের তৈরি পণ্য মাটির খেলনার জায়গা দখল করেছে। গান, পালাগান বা পুতুল নাচ এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। গ্রামীণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জায়গায় ঢুকে পড়েছে পপ কালচার বা সস্তা বিনোদনের মাধ্যম। আগের সেই সমবেত আনন্দের পরিবেশ আর নেই।
পরিবর্তনের মধ্যেও শীতকাল আজও গ্রামের মানুষের জীবনে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কৃষিজীবী মানুষ ফসল ঘরে তোলার পর শীতের আমেজে ছোটখাটো উৎসব করে। অনেক গ্রামে এখনও পিঠা উৎসব বা নবান্ন পালিত হয়। স্থানীয় স্কুল বা ক্লাবগুলো শীতকালীন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। শীতকালে গ্রামে বিয়ের অনুষ্ঠান বেশি হয়। 'শীতের বিয়ে' এখনো গ্রামীণ বাংলার আনন্দের বড় উপলক্ষ। এছাড়া শীতে লেপ-তোশক বানানো, মুরগি-হাঁস জবাই করে অতিথি আপ্যায়ন, এবং গ্রামের বড় পরিবারগুলোর মিলনমেলা শীত উৎসবের নতুন রূপ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
গ্রামীণ বাংলার শীত উৎসবের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে নতুন প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে। সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়াতে স্থানীয়ভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। বিদ্যালয়ে পিঠা উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, এবং খেলাধুলার আয়োজন করা যেতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রামীণ মেলার পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তি ও ঐতিহ্যের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে শীত উৎসবকে নতুন রূপে উপস্থাপন করা সম্ভব। এতে করে গ্রামীণ সংস্কৃতি টিকে থাকবে এবং নতুন প্রজন্ম তার শিকড়ের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে।
গ্রামীণ বাংলার শীত উৎসব আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অপরিহার্য অংশ। এটি শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি গ্রামের মানুষের ঐক্য, আনন্দ, এবং আত্মপরিচয়ের বহিঃপ্রকাশ। কালের পরিবর্তনে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও শীত উৎসবের মৌলিক আনন্দ গ্রামীণ জীবনে আজও প্রাণবন্ত। আমাদের উচিত এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কারণ শীত উৎসব শুধু গ্রামীণ বাংলার নয়, পুরো বাংলাদেশের এক অনন্য পরিচয়।
তামিম মিয়া
লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।