সোমবার ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কুমিল্লার চান্দিনায় মাছ চাষে নীরব বিপ্লব: এক নতুন দিগন্ত

ওসমান গনি, চান্দিনা প্রতিনিধি

কুমিল্লার চান্দিনায় মাছ চাষে নীরব বিপ্লব: এক নতুন দিগন্ত/প্রতীকি ছবি/রাইজিং কুমিল্লা

কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলায় কৃষি ও অর্থনীতিতে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হয়েছে, যার মূল চালিকাশক্তি হলো মাছ চাষ। একসময় ধানচাষে অভ্যস্ত এই অঞ্চলের বহু কৃষক ও বেকার যুবক এখন মৎস্য চাষকে বেছে নিয়েছেন লাভজনক পেশা হিসেবে। অনুকূল পরিবেশ, উন্নত চাষ পদ্ধতি এবং সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে চান্দিনা আজ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ এক জনপদ।

চান্দিনার বিস্তৃত প্লাবনভূমি অসংখ্য পুকুর-জলাশয় মাছ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এখানকার মাটি ও পানির গুণাগুণ মাছের দ্রুত বৃদ্ধি ও রোগমুক্তির জন্য সহায়ক। ঐতিহ্যগতভাবে ছোট পরিসরে মাছ চাষ হলেও, গত কয়েক বছরে তা বাণিজ্যিক রূপ নিয়েছে। স্থানীয় উদ্যোক্তারা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মাছ চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। কার্প জাতীয় মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল), পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, শিং, মাগুর সহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের উৎপাদন বহুগুণ বেড়েছে। বিশেষ করে, আধুনিক পদ্ধতি এবং পুকুর, দীঘিতে খাঁচায় মাছ চাষের মতো নতুন কৌশল অবলম্বন করায় উৎপাদন ব্যয় কমে এসেছে এবং মুনাফার পরিমাণ বেড়েছে। সফল মৎস্য খামারিরা নিজেদের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করছেন, যা এই বিপ্লবের গতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সাফল্যের মূল কারণ হলো স্থানীয় মৎস্যজীবীদের উদ্ভাবনী মানসিকতা এবং মৎস্য বিভাগের সঠিক দিকনির্দেশনা।

চান্দিনার মাছ চাষের এই নীরব বিপ্লব কেবল মাছের উৎপাদন বাড়ায়নি, এটি এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। মাছের চাষ ও ব্যবসার সম্পর্কে মৎস্য চাষে সফল একজন সফল ব্যবসায়ী পানি পাড়া গ্রামের আবু সালেহ জানান, কোন কর্মই ছোট নয় শুধু ইচ্ছা শক্তি ও মনোবল নিয়ে যে কোন ব্যবসা করলে সফল হওয়া অতি সহজ।মেহার গ্রামের মৎস্য চাষী আবুল কালাম জানান, আমরা যখন প্রথম মাছের চাষ ব্যবসা শুরু করি তখন মাছের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য দাম ছিল না। বর্তমানে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে মাছের দাম এবং মাছের খাদ্যের দাম ও অপ্রত্যাশিত হারে বেড়েছে, তারপরও আমাদের লাভ হচ্ছে।

বর্তমানে আমাদের মাছের চাষ ও ব্যবসার সাথে অসংখ্য বেকার যুবক কাজ করছে। এতে করে তাদের সাংসারিক অভাব অনটন অনেকটা কমে গেছে। একই কথা জানান, আরেকজন মাছ ব্যবসায়ী ও চাষী রোকন সরকার। তারা দুজনেই বলেন শত শত বেকার যুবকের জন্য টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। অনেকে সীমিত পুঁজিতে শুরু করে আজ সফল খামারি। মাছ চাষকে কেন্দ্র করে হ্যাচারি, মাছের খাবার উৎপাদন ও বাজারজাতকরণেও বহু মানুষের জীবিকা তৈরি হয়েছে। স্থানীয়ভাবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় চান্দিনা ও এর আশেপাশের এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। তাজা ও মানসম্মত মাছের সহজলভ্যতা মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। চান্দিনার মাছ এখন স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন বাজারে, এমনকি দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। এটি স্থানীয় অর্থনীতিতে বিশাল অঙ্কের অর্থ যোগান দিচ্ছে, যা চান্দিনার সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে সহায়ক হচ্ছে।

চান্দিনায় মাছ চাষের এই সফলতা ধরে রাখতে কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা প্রয়োজন। যেমন: মাছের সঠিক দাম না পাওয়া, মানসম্মত পোনা ও খাদ্যের নিশ্চয়তা, এবং রোগবালাই মোকাবিলায় আধুনিক প্রশিক্ষণের অভাব। তবে, মৎস্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। দেশীয় প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ, পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতি নিশ্চিত করা এবং মৎস্য চাষের মাধ্যমে আরও বেশি মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলাই হলো তাদের ভবিষ্যতের লক্ষ্য। চান্দিনার মৎস্য চাষিরা প্রমাণ করেছেন যে, স্বপ্ন আর পরিশ্রমের সংমিশ্রণে কৃষি ক্ষেত্রেও নীরব বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।

আরও পড়ুন