চট্টগ্রামের সঙ্গে কুমিল্লা জেলার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একটি বড় অংশ কুমিল্লায় হওয়ায় এমনটা ঘটছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও মৃত্যু চট্টগ্রামে। এরপরই অবস্থান কুমিল্লার। মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের ১০৫ কিলোমিটারে অনিয়ন্ত্রিতভাবে হালকা ও অননুমোদিত যানবাহন চলাচল করায় দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বেশি হচ্ছে।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ জানায়, মহাসড়ককেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে কুমিল্লা জেলায় দুর্ঘটনার হার বেশি। কুমিল্লার গুরুত্বপূর্ণ উপশহর, উপজেলা সদর ও বাজারগুলো মহাসড়ককেন্দ্রিক। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্পের অধীনে চান্দিনা, পদুয়ার বাজার, ক্যান্টনমেন্ট, চৌদ্দগ্রামসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বাইপাস করে সড়ক সম্প্রসারণকাজ করা হয়েছেন কিন্তু চার লেনের কাজ শেষ হওয়ার প্রায় এক দশকের মধ্যে মহাসড়ককেন্দ্রিক নতুন বাণিজ্যিক স্থাপনা ও বাজার সম্প্রসারণ হয়েছে।
সওজ আরও জানায়, কুমিল্লা জেলার অধীন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দ্রুতগামী যানবাহন, বাজারকেন্দ্রিক আঞ্চলিক ও জেলা সড়কের যানবাহন মহাসড়কে চলাচল থেমে নেই। তাছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহনের বাধ্যতামূলক বিরতির স্থান হওয়ায় দুর্ঘটনার হারও বেশি বলে মনে করছে সওজ।
সওজের কুমিল্লা সার্কেলের প্রকৌশলীদের মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য, হাটবাজারের কারণে অননুমোদিত ইউটার্নের সংখ্যা কুমিল্লায় বেশি। তাছাড়া আঞ্চলিক ও জেলা সড়ক থেকে নির্ধারিত হাটবাজার ও বিপরীত পাশের সড়কে যেতে ওভারপাস বা ইউটার্ন ব্যবহার কম হয়।
এসব বাজারকে কেন্দ্র করে কুমিল্লায় অসংখ্য ছোট ও স্বল্প গতির যানবাহনের চলাচল বেশি হওয়ায় কুমিল্লার জাতীয় মহাসড়কে দুর্ঘটনার পরিমাণ বেশি।
জানতে চাইলে বিআরটিএর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আয়নাল হুদা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কুমিল্লার দুর্ঘটনা ও নিহতের সংখ্যা চট্টগ্রামের কাছাকাছি, এটা সত্য। মহাসড়কে অতিরিক্ত দ্রুতগামী যানবাহন, অনিয়ন্ত্রিতভাবে অননুমোদিত ছোট ও কম গতিসম্পন্ন যানবাহনের আধিক্যের কারণেও কুমিল্লায় দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে।’ নিয়মিতভাবে অভিযান পরিচালনা সত্ত্বেও কুমিল্লা জেলার মহাসড়কে ‘মারুতি’ (স্থানীয় ভাষায়) নামের যানবাহনে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তিনি।
চট্টগ্রাম জেলার আয়তন ৫ হাজার ২৮৩ বর্গকিলোমিটার। এ জেলায় ১৩৩ দশমিক ৪৮ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক, ২১৬ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক এবং ৩৪২ দশমিক ৯২ কিলোমিটার জেলা মহাসড়ক রয়েছে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম জেলায় তিন ক্যাটাগরির সড়কের পরিমাণ ৬৯৩ কিলোমিটার।
অন্যদিকে কুমিল্লা জেলার আয়তন ৩ হাজার ৮৭ বর্গকিলোমিটার। এই জেলার জাতীয় মহাসড়ক ২০০ কিলোমিটার, আঞ্চলিক মহাসড়ক ৭২ কিলোমিটার এবং জেলা মহাসড়ক ৬১০ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে মোট সড়কের পরিমাণ ৮৮২ কিলোমিটার। সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, চট্টগ্রামের জনসংখ্যা ৯১ লাখ ৬৩ হাজার ৭৬০ জন। অন্যদিকে কুমিল্লা জেলার জনসংখ্যা ৬২ লাখ ১২ হাজার ২১৬ জন।
বিআরটিএর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে ২০২৩ সালে ৩১৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৮১ জন।
অন্যদিকে কুমিল্লা জেলায় ২৮০টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২৫৮ জন। এক বছরের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে কক্সবাজার জেলায় ৮০
জন।
এছাড়া বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ফেনী জেলায় ৭৬ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৭৯ জনের। কুমিল্লা ও ফেনীর সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বড় একটি অংশ বিদ্যমান থাকায় মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুহার বেশি বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
উল্লেখ্য সওজ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ছিল মাত্র দুই লেনের। ২০১৬ সালের দিকে চার লেন উদ্বোধনের পর এ সড়কে দুর্ঘটনার হার আরো বেড়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগকারী জেলাগুলোর বৃহৎ বাজারগুলো সড়কসংলগ্ন হওয়ায় ঝুঁকির পরিমাণও বেশি।
তাছাড়া দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত এ সড়কে কোনো সার্ভিস লেন না থাকায় উল্টোপথে যানবাহন চলাচল, অনিয়ন্ত্রিত ও অননুমোদিত ইউলুপের কারণে সড়কটিতে দুর্ঘটনার হার বেশি।
জানতে চাইলে সওজ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (কুমিল্লা সার্কেল) সুনীতি চাকমা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন মহাসড়ককেন্দ্রিক অংশে বাজার, ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে কম গতিসম্পন্ন যানবাহন চলাচল বেশি হওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে।’
মহাসড়কে নিয়মমাফিক সুযোগ-সুবিধা থাকলেও কুমিল্লায় অননুমোদিত ইউটার্ন, ওভারটেক দুর্ঘটনার হারকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যানবাহনগুলোর প্রধান বিরতি স্থান কুমিল্লা। এ কারণে কুমিল্লার কয়েকটি উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে কয়েকশ হোটেল-রেস্টুরেন্ট আছে।
তাছাড়া এসব বিরতি-অবকাশের বাণিজ্য সামনে রেখে মার্কেট, বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ হলেও পর্যাপ্ত ইউটার্ন কিংবা ওভারপাস রাখা হয়নি। ফলে সড়ক পার হওয়া, উল্টোপথে যানবাহন চলাচল, অপর্যাপ্ত টার্মিনালের কারণে সড়ক ও বাজারে যানবাহন পার্ক করায় দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছেন তারা।