জুন ১৮, ২০২৫

বুধবার ১৮ জুন, ২০২৫

করোনায় আতঙ্ক নয়, চাই সচেতনতা

প্রতীকি ছবি/সংগৃহীত

করোনাভাইরাস—এই এক শব্দেই পাল্টে গেছে গোটা পৃথিবী। স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থনীতি, থেমে গেছে শিক্ষা, ভেঙে পড়েছে স্বাস্থ্যখাত, আর মানুষের জীবনে নেমে এসেছে এক গভীর অনিশ্চয়তা। ২০১৯ সালের শেষভাগে চীনের উহানে শনাক্ত হওয়া এ ভাইরাস অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বজুড়ে মহামারির রূপ নেয়। বাংলাদেশও বাদ যায়নি এর ভয়াবহ থাবা থেকে।

তবে করোনাভাইরাসের প্রকৃত ভয় যতটা না ভাইরাসটির সংক্রমণে, তার চেয়েও বেশি আমাদের আতঙ্ক, গুজব এবং অসচেতনতার কারণে।

প্রথমদিকে করোনা সম্পর্কে মানুষ জানত খুব কম। ফলে শুরুতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন গুজব-নির্ভর চ্যানেল সেই আতঙ্ককে আরও উস্কে দেয়। হুট করেই জীবনের সমস্ত গতি থেমে যায়। লকডাউন, কোয়ারেন্টাইন, আইসোলেশন, সামাজিক দূরত্ব—এই সব শব্দ নতুন করে আমাদের জীবনে জায়গা করে নেয়। মানুষ দোকানপাটে ভিড় জমায়, পণ্যের অতিরিক্ত মজুদ করে, অনেকেই চিকিৎসা নিতে ভয় পেয়ে ঘরে বসেই মৃত্যুবরণ করে।

অথচ আতঙ্কিত না হয়ে শুরু থেকেই যদি আমরা সচেতন হতাম, তাহলে এই ভাইরাসকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত। সত্য হলো, করোনা যেমন ভয়াবহ, তেমনি এটি প্রতিরোধযোগ্য—শুধু দরকার সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও তথ্যভিত্তিক আচরণ।

প্রাথমিক ধাক্কায় দেখা গেছে—মানুষ জানে না কীভাবে ভাইরাস ছড়ায়, কীভাবে তা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হয়। সাধারণ সর্দি-জ্বর থেকে আলাদা করে করোনাকে চিহ্নিত করতে না পারায় প্রথমদিকে ব্যাপক আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। তথ্যের ঘাটতি ও ভুল বার্তার কারণে মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় নানা ভ্রান্ত ধারণা। অনেকেই গুজবকেই ধরে নেয় সত্যি হিসেবে। কেউ বলেছে রসুন খেলে করোনা হবে না, কেউ আবার কালোজিরা বা লবণ পানি গার্গলকে মনে করেছে প্রতিষেধক।

অথচ এসবের পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এই অসচেতনতার ভয়াবহ পরিণতি দেখা যায় প্রতিদিনের বাস্তবতায়। মাস্ক না পরা, স্বাস্থ্যবিধি না মানা, অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাফেরা—সবই অসচেতনতার বহিঃপ্রকাশ। একজন ব্যক্তির এই অবহেলা কেবল তার নিজের নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। সংক্রমণের চেইন ভাঙতে হলে প্রয়োজন ছিল ব্যাপক জনসচেতনতা—যেটি আমাদের সমাজে অনেক সময় অনুপস্থিত থেকেছে।

বাংলাদেশে করোনাকালে ছড়ানো গুজবগুলো ছিল চরম অজ্ঞতার প্রতিফলন। কেউ বলেছিল গরম পানি খেলেই ভাইরাস মরে যায়, কেউ বলেছিল লবণ-পানি দিয়ে গার্গল করলেই করোনা হবে না। কেউ আবার কালোজিরা বা ভেষজ উপাদানকে অলৌকিক ওষুধ ভেবে নিয়ম না মেনেই এসব খেয়েছেন। এতে অনেকে শারীরিকভাবে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এসব তথ্যের কোনোটিরই বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না। এমনকি করোনা আক্রান্তদের প্রতি সামাজিক আচরণ ছিল ভীতিকর। অনেকে রোগীকে একঘরে করেছে, কেউ কেউ রোগী শনাক্ত হলেই পাড়ায়-গ্রামে হুলস্থুল করেছে। মৃত্যুর পর দাফনে বাধা দেওয়া, হাসপাতালে রোগী নিতে অনীহা, অ্যাম্বুলেন্স আটকে দেওয়া—এসব আচরণ আমাদের সমাজের এক নিষ্ঠুর ও অসচেতন চেহারা ফুটিয়ে তুলেছে।

আতঙ্ক মানুষকে দুর্বল করে, আর সচেতনতা মানুষকে সাহসী করে তোলে। আতঙ্ক মানুষকে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে দেয় না, বরং ভুল পথে ঠেলে দেয়। অথচ সচেতনতা মানুষকে তথ্য বিশ্লেষণ করতে শেখায়, সংকটে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।

করোনাকালে যারা সচেতন ছিলেন যেমন নিয়মিত মাস্ক পরেছেন, হাত ধুয়েছেন, সামাজিক দূরত্ব মেনেছেন তারা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ থেকেছেন। আবার যারা গুজব বিশ্বাস করে অসাবধানতা দেখিয়েছেন, তারাই বিপদে পড়েছেন এবং অন্যকেও বিপদে ফেলেছেন।

প্রথমদিকে সরকার কিছুটা সময় নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখায়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্যখাত সক্রিয় হয়, করোনা টেস্ট, আইসোলেশন সেন্টার, হাসপাতালের সক্ষমতা বৃদ্ধি, টিকা কর্মসূচি চালু হয়। কিন্তু কেবল সরকারের পক্ষে একা এই বিপুল জনসংখ্যাকে সচেতন রাখা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন ছিল সমাজের প্রতিটি স্তরের সক্রিয় অংশগ্রহণ।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মন্দির, সামাজিক সংগঠন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি—সবাই যদি একসঙ্গে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণে থাকত। সৌভাগ্যবশত কিছু জায়গায় তা হয়েছে, কিন্তু সার্বিক চিত্র আশানুরূপ ছিল না।

করোনা সংক্রমণের প্রথম দফাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামো, প্রস্তুতি ও সমন্বয়ের ঘাটতি কতটা গুরুতর। দেশে পর্যাপ্ত আইসিইউ বেড ছিল না, ছিল না পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা। প্রাথমিকভাবে কোভিড পরীক্ষা করার মতো পরীক্ষাগারও ছিল সীমিত। অনেক হাসপাতাল চিকিৎসা দিতে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খেয়েছে।

চিকিৎসকদের সুরক্ষা ছিল অত্যন্ত সংকটাপন্ন। অনেক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন, সঠিক পিপিই ছাড়াই দায়িত্ব পালন করেছেন। এর ফলে অনেক চিকিৎসকই জীবন হারিয়েছেন, যা ছিল জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। এই অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে—স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু মানবিক দায় নয়, বরং তা স্বাস্থ্যব্যবস্থার টেকসই চালিকাশক্তি।

বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের পতন
ছবি: ওসমান গণি

করোনার আরেকটি বড় শিক্ষা হলো—প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতা বৃদ্ধির গুরুত্ব। রোগ হলে চিকিৎসা জরুরি, কিন্তু রোগ প্রতিরোধ করা আরও বেশি প্রয়োজন। হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা ইত্যাদি স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে যেসব সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হয়েছিল, তা স্বাস্থ্য শিক্ষার গুরুত্ব পুনরায় সামনে নিয়ে এসেছে। স্কুল, কলেজ এমনকি গ্রাম-গঞ্জের মানুষও স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কিছুটা হলেও সচেতন হয়েছে।

করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্যখাতে আমাদের কী পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে। অনেক হাসপাতালে আইসিইউ ছিল না, পর্যাপ্ত অক্সিজেন ছিল না, চিকিৎসকদের সুরক্ষা সরঞ্জাম ছিল সীমিত। সেই সংকট মোকাবিলায় সরকার চেষ্টা করলেও, দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনার ঘাটতি এক মুহূর্তে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। এই মহামারির অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখনই স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজাতে হবে।

ভবিষ্যতের যেকোনো মহামারিতে যেন আমরা প্রস্তুত থাকি—সে জন্য জরুরি পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে। করোনাকাল ছিল এক দীর্ঘ মানসিক পরীক্ষার সময়। পরিবারের সদস্যদের বিচ্ছিন্নতা, কর্মহীনতা, আর্থিক অনিশ্চয়তা ও মৃত্যুভয় মানুষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। অনেকেই হতাশাগ্রস্ত হয়েছেন, আত্মহত্যার ঘটনাও বেড়েছে।

আবার অনেক পরিবারে দেখা দিয়েছে সহিংসতা। এই অভিজ্ঞতা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে—শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষাও জরুরি। ভবিষ্যতে যেকোনো দুর্যোগে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে পরিকল্পনার অংশ করতে হবে।

করোনার সময় আমরা যেমন কিছু অমানবিক আচরণ দেখেছি, তেমনি অনেক মানবিক উদাহরণও দেখেছি। কেউ অসহায়দের খাবার দিয়েছেন, কেউ বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছেন, আবার কেউ নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলে অন্যকে বাঁচিয়েছেন। এমন স্বেচ্ছাসেবীরা আমাদের আশার প্রতীক। এই ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা যেকোনো মহামারির সময় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার মতো অতিমারী ভবিষ্যতেও আসতে পারে। আমরা জানি না সেই রোগ কী হবে, কোথা থেকে আসবে কিংবা কতটা ভয়ংকর হবে। কিন্তু আমরা যদি করোনার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিই, তবে ভবিষ্যতের যে কোনো সংকটে অধিক প্রস্তুত ও আত্মবিশ্বাসী হতে পারব। এই প্রস্তুতির মূল ভিত্তি হতে হবে সচেতনতা। সচেতন নাগরিক মানেই দায়িত্বশীল নাগরিক। আর দায়িত্বশীল নাগরিকরাই পারে একটি সমাজ, একটি রাষ্ট্র ও একটি জাতিকে সুরক্ষিত রাখতে।

করোনাভাইরাস আমাদের জীবনে এক বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তন কখনো ভয়াবহ ছিল, কখনো শিক্ষণীয়। কিন্তু এই সংকট আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে—আতঙ্ক নয়, বরং বিজ্ঞান, তথ্য ও মানবিক মূল্যবোধই আমাদের রক্ষা করতে পারে।

তাই এখন থেকে আমাদের স্লোগান হোক “আতঙ্ক নয়, চাই সচেতনতা। গুজব নয়, চাই সত্য ও সহমর্মিতা।” একটি সচেতন জাতিই পারে যেকোনো দুর্যোগের মোকাবিলা সফলভাবে করতে।

আরও পড়ুন