মে ৫, ২০২৫

সোমবার ৫ মে, ২০২৫

উত্তরবঙ্গ বাস জার্নিতে হুজুর হুজুর মশাই

উত্তরবঙ্গ বাস জার্নিতে হুজুর হুজুর মশাই
উত্তরবঙ্গ বাস জার্নিতে হুজুর হুজুর মশাই

ঘটনার প্রেক্ষাপট ২০০৯ সাল।

পদ্মা এক্সক্লুসিভ বাসে উঠলাম দিনাজপুর গনেশতলা থেকে। আমার আসনে বসতেই নুরানী চেহারার বেশ নাদুস-নুদুস এক হুজুর আমার আসনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো–ভাই সাহেবের কি বমি করার অভ্যাস আছে?

লোকটির প্রশ্ন শুনে তার দিকে একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখি হাতে বিভিন্ন ধরনের পোটলা,পায়ের কাছেও বিভিন্ন ধরনের ছোট গিট্টু লাগানো ব্যাগ।

আমি লোকটির আপাদমস্তক দেখে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটি আবারো মৃদু হেসে প্রশ্ন করলো–কি, ভাইসাব, আছে নাকি বমি করার অভ্যাস?আগে থাকতে কইয়া দেন,আমি আপনার লগে বমু, আর আপনি কথা নাই, বার্তা নাই, অক্ কইরা ছাইড়া দিলেন আমার গায়ে।

তহন আমার ওযু একদম শেষ। শত হইলেও আমি পা্চ ওয়াক্ত নামাজি বান্দা। ওযু কইরাই বাসে উঠছি, আল্লাহর দোহাই বমি কইরা আমার অযু ভাইঙ্গেন না।

মেজাজটা আগে থেকেই গরম ছিলো। একে তো বাসের টিকেট পেয়েছি একদম পিছনে,কপালে কত্ত ঝাঁকুনি আছে তা আল্লাহই জানে।তার উপর যদি পাশের সিটে এমন যাত্রী জুটে,তবে পুরো এই নাইট জার্নি কীভাবে কাটবে?এটা ভাবতেই মাথায় পুরো রক্ত উঠে যাচ্ছে।

বেশ রাগের সঙ্গে উত্তর দেই আমি,”না”আমার কোনো বমির অভ্যাস নাই।আর বমির যে অভ্যাস থাকতে পারে তা আগে জানতাম না।এটা তো আর পান, সিগারেটের অভ্যাস নয়,যখন মনে হলো তখন অভ্যাস মতো কারো গায়ে বমি করলাম।

আরে ভাই, রাগ করেন ক্যা?গোস্বা কইরেন না, আমি একটু সাবধানী মানু। সব কাম-কাজ করার আগে চিন্তা ভাবনা কইরা লই। যাউগ্যা, তয় আরামেই বই,কি কন?

এ কথা বলতে -বলতে তার বিশাল বপুটা নিয়ে হুজুর সাহেব আমার পাশের সিটে এবং আমার সিটেরও কিছু অংশ দখল নিয়ে বসে পড়েন।

সন্ধ্যা সাতটায় নাইটে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে গাড়ি ছাড়লো।

গাড়ি ছাড়তেই কানে এয়ারফোন লাগিয়ে তফাজ্জল হুজুরের মায়ের কান্দন ওয়াজটা শুনছিলাম। গাড়ি দশমাইল পার হয়ে সামনে আসতেই হুজুর সাহেব তার মাল-সামানের হিসাব-নিকেশ করতে লাগলেন।

তারপর আবার দাঁড়িয়ে পোঁটলা-পু্ঁটলির কিছু উপরের মাল রাখার জায়গা রাখতে লাগলেন।

আমি শঙ্কিত দৃষ্টি নিয়ে দেখতে লাগলাম তার কাণ্ড কারখানা।

বাস আবার দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো।এদিকে তখনো হুজুরের মাল রাখা শেষ হয়নি।ঠেসে-ঠুসে রাখার চেষ্টা করছেন।এমন সময় কি যেন কি কারণে বাস কড়া ব্রেক দিলো।

ব্যস, হুজুর সাহেব উড়ে গিয়ে পড়লেন সামনের সিটের এক মহিলার কোলে।আর তাঁর সাধের পোঁটলা-পুঁটলির বড় অংশ বৃষ্টি ধারার মত ঝরে পড়ল আমার মাথায়।

মহিলার কোল থেকে লজ্জিত হাসি নিয়ে উঠে এলেন হুজুর সাহেব।

মা জননী, আপত্তি নিয়েন না।আমার কোনো দোষ নাই।বাসের ধাক্কাডা সামলাইতে পারি নাই।

মহিলা বিরক্ত মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলেন।এ ছাড়া তার কী..বা করার ছিল?

হুজুরের পুঁটলায় কি ছিলো জানি না।কিন্তু দেখি আমার মাথা কেমন যেন ভেজা-ভেজা। ওমা..,কেমন যেন গন্ধও আসছে।হাত দিয়ে মাথা মুছে নাকের কাছে এনে দেখি, কাঁচা ডিমের গন্ধ।

বেটা বেআক্কেল হুজুর নিশ্চয় পোঁটলায় করে ডিম এনেছে। সেই পোটলা আর আমার মাথার সংঘর্ষে ফেটে চৌচির ডিম।

দৌড়ে এসে যথাসম্ভব পুঁটলা-পুঁটলি গুলো গুছিয়ে নেন হুজুর সাহেব।তারপর সিটে বসে আমার দিকে চেয়ে বললেন-ভাইসাব,আপনি যাবেন কোথায়?

বাস যেহেতু কুমিল্লায় যাচ্ছে, আমিও বাসের সঙ্গে কুমিল্লায় যাবো।দিনাজপুরের বাসে চেপে তো আর সিলেট যাওয়া যায় না। আবারো রাগের সঙ্গে উত্তর দেই।

ও..তা তো ঠিকই।আমিও কুমিল্লা লাকসামে যামু। হওর বাড়ি আইছি, বউডার লাইগ্যা তার মায় সের দুই পোলাওয়ের চাউল,দুই ছড়ি কলা,কয়ডা আইট্টা কলার মোচা,এক টিন মুড়ি আর বাড়ির হাসের চার হালি ডিম লইছি।

আমার বউডা তার মা বাবার একমাত্র কইন্যা, বহুত হোয়াগ করে এগুলো মাইয়ার লাই দিছে। কামডা ভালা করছি না, কন?মুই খুব সাবধানী আর আল্লা-বিল্লা করনেওয়ালা মানু।হুদাই কোনো ভুল করি না।

মনে মনে বললাম, ব্যাটা এইসব ছাইপাঁশ কি কুমিল্লায় পাওয়া যায় না?আর তোমার হাঁসের ডিম এখন ভর্তা। ব্যাটা ছাগল! কিন্তু মুখে কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এর কথায় জবাব দিলে আরো খাঁজুরা আলাপ শুরু করবে।

হয়তো আমার দিক থেকে কোনো জবাব না পেয়ে হুজুর উসখুস করতে লাগলেন।বুঝতে পারছি, কারো সঙ্গে প্যাচাল না করতে পারার জন্য মুখ বিমর্ষ।এদিক-ওদিক তাকালেন।কিন্তু কেহই তার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না।

সবাই সিটে ঝিম মেরে পড়ে আছে।নাইট বাস এমনই হয়। অধিকাংশ মানুষই বাসে ওঠে ঝিমাতে থাকে।কারো সঙ্গে আলাপ জুড়তে না পেরে হুজুর সাহেব এবার পড়লেন তাঁর সিট নিয়ে।সিটের এক পাশে একটা লিভার থাকে,সিট শোয়ানো বা উঠানোর জন্য।

সেটা নিয়ে শুরু করলেন টানাটানি।তারপর হঠাৎ করে সিটটা একদম পিছন দিকে শুয়ে দিলেন পিছনের সিটের যাত্রীর উপর। সে যাত্রী আবার এক চ্যাংড়া যুবক।সঙ্গে সঙ্গে হুজুরের ঘাড় ধরে আবার তাকে আগের অবস্থায় এনে সিটটা সোজা করে বললেন-ওই মিয়া, চৌক্ষে দেহেন না?চ্যাংড়া যুবকের কথায় ভয় পেয়ে কিছুটা কুকঁড়ে সিটের মধ্যে সেঁধিয়ে যান হুজুর সাহেব।এবার বিমর্ষ মনে সেভাবেই ঝিমাতে থাকেন।

আমি মনে মনে বলি-যখনই বাসে করে যাই,তখনই এমন সহযাত্রী কপালে জুঁটে কেন?অবশ্য যে কপাল নিয়ে এসেছি,তাতে তো এমনই হবে।বন্ধুদের কাছে কত্ত গল্প শুনি,বাসে পাশে সুন্দরী তরুনী এসে বসে।

তাদের সঙ্গে কত গল্প, কত কথা,এমন কি মন দেওয়া-নেওয়াও হয়ে যায় ঐ অল্প সময়টুকুর মধ্যে।তারপর মোবাইল নাম্বার নিয়ে পুরো প্রেম চালিয়ে যাচ্ছে।

আর আমার এমনই পোড়া কপাল,আশে-পাশে সুন্দরী তরুনী তো দূরের কথা, সিটই পুরোটা নিজের করে পাই না।সিটে বেশির ভাগই হুজুগে কিছু লোক এসে জুটে।

এসব ভাবতে ভাবতে আমারও কেমন যেন ঝিমুনিতে পেয়ে বসলো। চোখে যেন রাজ্যের ঘুম।

ঝিমাতে-ঝিমাতে মনে হলো কোথায় বাস আর কোথায় কী,আমি যেনো বনের রাজা টারজান। নেংটি পরে ছোড়া হাতে ঝোপের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে আছি।এখনই সিংহ আসবে।আমি ঝাঁপিয়ে পড়বো তার ঘাড়ে।ওই তো, ব্যাটা আসছে।

আয়..আজ তোর একদিন কি আমার একদিন…আরেকটু কাছে আসতেই মাতোয়ারা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি সিংহের গায়ে। একহাতে আঁকড়ে ধরি ওর কোমর, আর অন্য হাতে চাকু নিয়ে তার পেটে ঢুকিয়ে খোঁচাতে থাকি।

সিংহ ব্যাটাও মহা ধুরন্ধর!বাউলি কেটে সরে যেতে চায়।আমিও বনের রাজা টারজান। এত সহজে পসর পাবে না।দুই হাত ব্যস্ত, তাই মাথা দিয়ে চেপে ধরি ব্যাটাকে।হঠাৎ সিংহটা কথা বলে ওঠে–ভাই সাহেব, আমারে ছাড়েন..ওরে,মোর খোদা, আমারে বাঁচাও….

অবাক হয়ে সিংহের মুখের দিকে তাকাই।কোথায় সিংহ! এ তো দেখি সেই হুজুর! সিংহ ব্যাটা হুজুর হয়ে গেলো কীভাবে?যে হাতে সিংহের কোমর ধরেছিলাম,সে হাত দেখি হুজুরের লম্বা দাড়ি ধরে টানছি।আর মাথা দিয়ে তার পেটে ঢোঁ মারছি। কী সর্বনাশ!

হুজুরের চিল্লানিতে আশে-পাশের সব সিটের যাত্রীরাও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

বাসের সুপারভাইজার এসে সিটের পাশে দাঁড়িয়ে ঘুমজড়িত কণ্ঠে বলল–ভাইজান, বাসে উঠার আগে হুক্কামুক্কা খাইছেন নাকি?এতো উল্টা-পাল্টা স্বপ্ন দেখেন কিল্লাই?যত্তসব..এখন ছাড়েন ঐ হুজুরের দাড়ি মোবারক। চোখে মুখে পানি দিয়া বসেন।

হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি লোকটা আতঙ্কে সিঁটিয়ে গেছে।সিটের ওপাশে যত দূর সম্ভব সরে গেছে।পারলে সিট ভেঙ্গে ওপাশে পড়ে যায়-যায় অবস্থা!

আমি তাড়াতাড়ি দাড়ি ছেড়ে নিজের সিটে চোরের মত বসে পড়লাম।আমার মুখে কোনো কথা ছিল না।এরকম সময় অনেকেরই থাকে না।

কিছুক্ষণ পর মৃদু স্বরে বললাম–“সরি”।

হুজুর আমার কথা শুনলেন বলে মনে হলো না।

শুধু আমার গলার স্বরে আরো আতঙ্কিত হয়ে সিটের ওপাশে আরো সরে গেলেন।

বাস চলতে লাগলো আপন গতিতে।

রাত দুটোয় বাস সিরাজগঞ্জ ফুড প্যালেস এ যাত্রা বিরতি দিলো। হুজুর তড়িৎ ওঠে সুপারভাইজারের সাথে গুজুর-গুজুর করছেন।সম্ভবত অন্য কোনো সিটে যাবার আবদার।আমি চুপচাপ নিজের সিটেই বসেছিলাম।

সুপারভাইজার হঠাৎ জোরে বলতে লাগলেন–আরে..কোন ভয় নাই,নিজের জায়গায় বসেন গিয়া।আমি তো আছি, কোনো অসুবিধা হইলে কইয়েন।

হুজুর সাহেব খানা পিনা ও হিসু বর্জন করে বাসে বসতেই আমিও প্রাকৃতিক কাজ ও হালকা চা খেয়ে নিজ আসনে বসে পড়লাম।

হুজুর একদম সাইলেন্ট। আমিও জানালা দিয়ে বাহিরের দৃশয়পট দেখতে ব্যস্ত।

আবার চলা শুরু করলো বাস।

শুরু হলো আবার সবার ঝিমুনি।আমি চোখ বিস্ফোরিত করে থাকলাম,যাতে ঘুম না আসে।নিজেকে আর বিস্বাস করতে পারিনা। কিন্তু, পাঠকগণ আপনারা তো জানেনই,ঘুম হলো এমন এক জিনিস,তা যখন দরকার, তখন আসেনা।আর যখন না হলেও চলে,তখন চোখের পাতায় চেপে বসে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আবার নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।এবার মনে হলো আমি যেন মহা বীর আলেকজান্ডার।যুদ্ধ জয় শেষে বিজয়ের পতাকা ওড়াবো।পতাকাটা ধরে টানতে থাকি উড়াবো বলে।কিন্তু কে যেন ওপাশ থেকেও পতাকাটা টানছে।কে সেই নালায়েক!আরো জোরে টান দেই। সঙ্গে সঙ্গে কানের কাছে হাউ-মাউ করে উঠলো কে যেন।

ওরে মোর আল্লাহ..মোর পাঞ্জাবী ও লুঙ্গি লইয়া গেলোরে….ওহে বাসের ভাইয়েরা, না ঘুমাইয়া আমার ইজ্জত বাঁচান…

আপনারাই কহেন, এরকম চিল্লাচিল্লিতে পতাকা কি টাঙানো যায়?বাধ্য হয়ে ঘুম থেকে জাগতে হলো।এ কী কাণ্ড! হুজুরের

অর্ধেক লুঙ্গি আমার হাতে!বাকী অর্ধেক দিয়ে কোনো মতে ইজ্জত বাঁচিয়ে চলছেন হুজুর সাহেব।

তাড়াতাড়ি লুঙ্গি ছেড়ে দিয়ে ভদ্র হয়ে বসি।কিন্তু হুজুরের আতঙ্ক কমলো না একবিন্দুও। রাজ্যের অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে।বাসের যাত্রীরা বা সুপারভাইজার কেউই এবার ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। কারণ, সবাই তো শেষ রাতের ঝিমুনির মধ্যে আছে।

আমিও আবার চোরের মতো সিটের মধ্যে গুটিয়ে যাই। আড়চোখে দেখি, হুজুরের ঠোঁট নড়ছে।সম্ভবত দোয়া-দরুদ পড়ছেন।

এমন সময় বাস ঢাকা সাভার পৌঁছালে কিছু যাত্রী নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো।কয়েক জন ঘুমকাতুরে চোখে নামার জন্য দরজার দিকে যেতেই হুজুর সাহেবও হঠাৎ দৌড়ে অন্যদের সাথে পাল্লা দিয়ে নামতে লাগলেন।

সুপারভাইজার বললেন-কী হুজুর, আপনি না কুমিল্লায় যাইবেন,তয় এখানে কিল্লাই নামেন?

না, আমি এইহানেই নামুম।

এ কথা বলেই হুজুর সাহেব উদ্ভ্রান্তের মত একদিকে হাঁটতে লাগলেন।

আমার পায়ের কাছে কি যেন পুঁটলার মত ঠেকে।চেয়ে দেখি সাবধানি হুজুর সাহেব তার সব পুঁটলা-পুঁটলি ফেলেই বাস ছেড়ে নেমে গেছেন।জানালা দিয়ে গলা বের করে দেখি,দূরে হুজুর সাহেব জোরে জোরে হাঁটছেন।

গলা উঁচু করে ডাক দেই–ও..হুজুর, আপনার জিনিসপত্র নিয়ে যান, ও হুজুর………..

আমার কথা হুজুর সাহেবের কানে পৌঁছায় কিনা জানি না। তবে একবার পিছনে ফিরে আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দেন।

মাথাটা বাসের ভিতর এনে ভাবি,আর যাই হোক,এই বাস যাত্রায় আমার ইনকাম হলো –সের দুই পোলার চাউল,দু ছড়া কলা,কয়েকটা কলার মোছা,এক টিন মুড়ি আর আস্ত ভেঙ্গে যাওয়া কয়েকটা দেশি হাঁসের ডিম।

আরও পড়ুন