
কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার মুরারীপুর গ্রামের খামারিরা এখন দম ফেলারও ফুরসত পাচ্ছেন না। ঈদ যত কাছে আসছে, ততই তাদের ব্যস্ততা বাড়ছে কোরবানির জন্য প্রস্তুত দেশি গরুগুলোর পরিচর্যায়। এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই গরুর খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছে এবং কোরবানির বাজারে এখানকার গরুর বিশেষ চাহিদা রয়েছে।
মুরারীপুর গ্রামের চিত্র অন্যান্য গ্রাম থেকে একেবারেই আলাদা। এখানে কমবেশি প্রতিটি বাড়িতেই গড়ে উঠেছে গরুর খামার। কোনো খামারে ৩টি, আবার কোনোটিতে ৫০টি পর্যন্ত গরু দেখা যায়। স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে এই গ্রামের গরু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়। তবে কোরবানির ঈদ এলেই যেন এই গ্রামে উৎসবের আমেজ লাগে। কে কত টাকার গরু বিক্রি করতে পারলো, তা নিয়ে চলে নীরব প্রতিযোগিতা।
বীরগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পশু চিকিৎসক সুনীল কুমার রায় জানান, ২০১৯ ও ২০২০ অর্থবছরে তাদের তত্ত্বাবধানে মুরারীপুরের ২০ জন খামারিকে গরু মোটা-তাজাকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। সেই প্রশিক্ষণের হাত ধরেই খামারিরা ছোট পরিসরে খামার শুরু করেন। বর্তমানে এই গ্রামের প্রায় ৯৫ ভাগ বাড়িতেই গরু মোটা-তাজাকরণের খামার তৈরি হয়েছে, যা স্থানীয় তরুণ ও যুবকদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
খামারিরা জানান, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের নিয়মিত সহযোগিতা পাওয়ায় তারা খামার পরিচালনায় অনেক সুবিধা পান।
শাহাপাড়ার খামারি শামিম হোসেন বলেন, “২০২০ সালে বাবার দেওয়া ২৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরুর বাছুর কিনে খামার শুরু করি। এখন আমার খামারে বিদেশি জাতের ১০টি গরু আছে, প্রতিটির দাম প্রায় ৩ লাখ টাকা। এছাড়াও দেশি জাতের ২০টি ষাঁড় কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছি। গরুর খামার করেই আজ আমি স্বাবলম্বী।”
একই গ্রামের আব্দুল কাদের বলেন, জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার কারণেই আজ তারা সফল খামারি হতে পেরেছেন। মুরারীপুর গ্রাম এখন গরুর খামারের জন্য দেশের মধ্যে একটি মডেল গ্রাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভেটেরিনারি সার্জন ডা. আশিকা আখতার তৃষ্ণা জানান, এ বছর জেলায় কোরবানির জন্য ৫৩ হাজার ৫১৪টি আড়িয়া গরু, ৩৪ হাজার ৫৩৫টি বলদ গরু, ২৯ হাজার ৩৮৩টি গাভী এবং ৭ হাজার ২৬৩টি মহিষসহ মোট ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৯৫টি পশু প্রস্তুত রয়েছে। জেলার চাহিদা ৯৫ হাজার হলেও, উদ্বৃত্ত পশু দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চাহিদা মেটাতে সহায়ক হবে।
অন্যদিকে, জেলায় ৬৮ হাজার ২৪২টি ছাগল ও ৩ হাজার ৭টি ভেড়া কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে, যেখানে চাহিদা মাত্র ৩৭ হাজার।
বীরগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. মুহিববুর রহমান বলেন, “মুরারীপুর গ্রামের মানুষের আগ্রহ এবং আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আজ এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষ গরুর খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। আমরা চাই, এই মডেল পুরো উপজেলায় ছড়িয়ে যাক, যাতে সবাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।”
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আব্দুর রহিম মনে করেন, সারা দেশে এমন কোনো গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে সবাই গরুর খামার করেছে। খামারি ও কর্মকর্তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় এটি সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, যদি সারা দেশে মুরারীপুরের মতো গরু মোটা-তাজাকরণ খামার তৈরি করা যায়, তাহলে একদিকে যেমন মাংসের ঘাটতি পূরণ হবে, তেমনি বেকার সমস্যাও অনেকাংশে কমে যাবে। কোরবানির ঈদে জেলার সিংহভাগ গরুর চাহিদা এই গ্রামের খামারিরাই পূরণ করে থাকেন বলে তিনি জানান।