বুধবার ২৯ অক্টোবর, ২০২৫

ইউরোপে নেয়ার কথা বলে টিকটক ও ইউটিউবে প্রতারণার ফাঁদ, নিঃস্ব ভুক্তভোগিরা

সঞ্জয় শীল,নবীনগর,ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

Rising Cumilla -Destitute victims of TikTok and YouTube scams claiming to take them to Europe
ইউরোপে নেয়ার কথা বলে টিকটক ও ইউটিউবে প্রতারণার ফাঁদ, নিঃস্ব ভুক্তভোগিরা/ছবি: প্রতিনিধি

উন্নত জীবনের আশায় ও স্বপ্নের দেশ ইউরোপের ইটালি, পর্তুর্গাল, পোল্যান্ড, ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ডে যাওয়ার জন্য প্রতারক পারভেজকে (৩০) বাড়ি-ঘর, জমি বিক্রি করে নগদ টাকা দিয়ে নিঃস্ব মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী ও দেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা, কিশোরগঞ্জ জেলা ও কুমিল্লা জেলাসহ একাধিক জেলার অসংখ্য স্বপ্নবাজ তরুন। পারভেজের বিরুদ্ধে দেশের একাধিক থানায় প্রতারণার মামলাও রয়েছে বলে জানা গেছে। তার খুঁজে পুলিশের টিম এলাকায় গিয়েছিলো বলেও জানা যায়।

পারভেজের গ্রামের বাড়িতে সরজমিনে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহকালে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে স্থানিয়দের কাছে জানতে চাইলে অনেকেই স্ব-ইচ্ছায় এগিয়ে এসে জানান এই প্রতারক পারভেজের বিভিন্ন ফাঁদের বিবরণ ও প্রতারিত হওয়ার ঘটনা।

স্থানিয়দের কাছ থেকে পারভেজের একাধিক টিকটক আইডি ও ইউটিউবের লিংক পাই। পারভেজ নিজেকে টিকটক আইডিতে ব্লগার ও ট্রাবলার বলে উল্লেখ করলেও একাধিক ভিডিওতে কখনো ইল্যান্ড, কখনো নিউজিল্যান্ড আবার কখনো বা পোল্যান্ডের কথা বলে স্পন্সর দেয়া ভিডিওতে উদ্ভুদ করছেন কেউ ইউরোপের স্বপ্নের দেশে আসতে চাইলে তার সাথে যোগাযোগ করতে।

কয়েকটি ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ও কোম্পানির ছবির ফটো কপি দেখিয়ে বলছেন, কুমিল্লার কামাল ভাই আপনার কাজ হয়ে গেছে, আপনি দ্রুত প্রস্তুতি নিন। আমাদের আগে সময় লাগতো ২-৩ মাস কিন্তু গভের্মন্টে চেইঞ্জ হওয়াতে ৫-৬ মাস লেগেছে। এখন আমার কাছে অনেক অফার লেটার আছে, ভিসা ইস্যু আছে। চিন্তার কোন কারন নাই। আমার কাছের একজন ভাই, যার ওয়াইফ আমাকে অনেক ভালোবাসে। আপনি রেডি হন। যোগোযোগের জন্য দেয়া আছে হোয়াটসঅ্যাপের +৬৪২০৪৩৪৭২১০ ও ৪৮৭৩২২৩১৩৩১ এ দুটি নাম্বার।

travelar with abir নামে থাকা একটি ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিওতে নিজেকে ট্রাবলার বলে পরিচয় দিলেও কেবল প্রতারণার ফাঁদে ভরা। স্থানিয়রা জানান, সে স্কুলে কোন দিন পড়াশোনা না করলেও তার সুন্দর বাচন ভঙ্গি, মিষ্টি কথায় ও পোষাক-আষাকে যে কেউ ফাঁদে পড়বে। তার আরো একাধিক ফেসবুক আইডি ও ইউটিউব আইডি থাকলেও সেগুলোতে গ্রামের মানুষদেরকে ব্লক করে রেখেছেন বলে জানান স্থানিয়রা। ভিডিও গুলোতে তার সাথে আরো দুজনকে দেখা গেছে।

স্থানিয় বাসিন্দা নাছির মার্কেটের পাশের বাড়ির জুয়েল মিয়া জানান, আমি একজন প্রবাসী। আমাকে সে অনেকবার চেষ্টা করেছিলো ইউরোপের কথা বলে টাকা নিতে। আমি লোভে পরার আগেই শুনি সে ভুয়া কাগজ ও ভিসার কথা বলে এলাকা থেকে টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে। তার অনেকগুলো ফেসবুক আইডি, টিকটক আইডি ও ইউটিউব আইডি থাকলেও এগুলো এখন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

স্থানিয়দের জিজ্ঞাসা করেছিলাম পারভেজ গরীব ও ইট-ভাটায় কাজ করতো জেনেও কেন আপনারা টাকা দিলেন, উত্তরে তারা সবাই এক কথাই জানান। নিজেদের লোক ও তার পোষাক-আশাকের পরিবর্তন ও গরীব হওয়াতে তার কাছ থেকে টাকা আদায় সহজ হবে ভেবে। এও জানান, তারা ভেবেছিলেন পারভেজ সত্যিই কোন লিংক পেয়েছেন যাতে তার ভাগ্য খুলে গেছে!

মাটির ভিটের দু’চালা টিনের ঘরে ৭ ভাই ও মা-বাবা নিয়ে বাস করতো এই পারভেজ। ৭ ভাইয়ের মাঝে বড় ছেলে পারভেজ। পারভেজের ১০ বছর বয়সে তার মা মারা গেলে দ্বিতীয় বিয়ে করেন ইট ভাটার শ্রমিক বাবুল মিয়া। বর্তমানে বাড়িতে কেউ থাকেন না। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হওয়া ভুক্তভোগিরা বাড়িতে এসে তার বাবাকে ধরলে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী ও ৬ ছেলে সন্তানদের নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান। স্থানিয়রা জানান, ভিটে বাড়িটি ছাড়া তাদের তেমন কোন সহায় সম্বল ও জমি নেই। কোথায় চলে গেছেন এ বিষয়ে জানেন না কেউ। দীর্ঘ ০৪ বছর ধরে এভাবেই পড়ে আছে প্রায় দেড় শতক জমিতে থাকা টিনের বসত ঘরটি।

জানা যায়, পারভেজের মা মারা গেলে সে কিশোরগঞ্জে গিয়ে খুব অল্প বয়সেই সোহানা নামের সেখানকার এক তরুনীকে বিয়ে করে গ্রামে নিয়ে আসেন । তাদের ঘরে ৭ বছরের খাদিজা ও ৫ বছরের খুশবু নামে দুটি কন্যা সন্তান থাকা সত্ত্বেও টিকটকার অদিতি নামে এক মেয়েকে বিয়ে করে প্রথম স্ত্রী সন্তানদের ফেলে চলে যায় সে। পরে দীর্ঘ দিন অপেক্ষার পর তার প্রথম স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। তবে প্রথম স্ত্রী সোহানার বাড়ি কিশোরগঞ্জের কোথায় ও অদিতির বাড়িও কোথায় এ ব্যাপারে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।

পারভেজের আপন চাচাতো ভাই এনামুল মিয়া দীর্ঘ ১০ বছর ছিলেন দুবাইয়ে। এনামুলকে পোল্যান্ডের স্বপ্ন দেখিয়ে দুবাই থাকাকালিন হাতিয়ে নেন তার সারাজীবনের কামাইয়ের নগদ অর্থ ও ধারকর্যে আনা ৬ লক্ষ টাকা । পরে তাকে দেশে এসে পোল্যান্ডের জন্য প্রস্তুতি নিতে বললে এনামুল দেশে ফিরে এসে বুঝতে পারেন তিনি প্রতারিত হয়েছেন। এখন তিনি এলাকায় রিক্সা চালিয়ে কোন রকমে সংসার চালাচ্ছেন।

এনামুলের স্ত্রী অঞ্জনা জানান, আমার দুইডা প্রতিবন্ধি পুত, হেরার মাতাত ধইরা কিরা কাইট্ট টেহা নিচে, এরফর আর কুনু দেহা নাই আজগা চাইর বছর অইচে।

প্রতারনার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হওয়া আমির হামজা জানান, আমি ৫ লক্ষ ২০ হাজার টাকা দিছি আমার পুতেরে নেয়ার লেইগ্যা। টেহা দেয়ার ফর আমারে কইলো, ট্রেনিং করান লাগবো। চিটাগাং নিতে অইবো। গেলাম চিটাগাং, গিয়া দ কুনু বুঝলাম না কি করে আর কি ক। চিটাগাং ঘুরাইয়া ফরে আবার ক ঢাহা যাইতে অইবো। গেলাম পুতেরে লইয়া ঢাহা। হে ক ( পারভেজ) আবার টেহা দিতাম। এর ফরই সন্দেহ অইলো। ঢাহা থেইক্কা আওয়ার পর হের নাম্বারে ফোন দিলে আর ঢুহে না। বন্ধ ক।

প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিজে সর্ব শান্ত হওয়ার পাশাপাশি অন্যদের টাকার জিম্মাদার হয়ে বিপদে পড়েছেন একই এলাকার জয়নাল মিয়া। তার কাছ থেকে তারসহ একাধিক ব্যক্তির ৮০ লক্ষ টাকা নেয়ার কথা জানা যায়।

আম্বিয়া জানান, ছোড থেইক্কা হেরে দেকচি, হে যে ইমুন বিশ্ববাটফার অইবো আমরা জানতাম না। যারতে পারচে হেরতে অই টেহা নিচে। অহন হুনি সারা দ্যাশের থেইক্কা অই হে টেহা নিয়া বাটফারি করতাছে।

স্থানিয়ভাবে “বিশ্ববাটপার’ নামে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলার নবীনগর উপজেলার বড়াইল ইউনিয়নের ১ নং ওর্য়াডের বড়াইল গ্রামের শান্তি বাড়ির বাসিন্দা মো. বাবুল মিয়ার ছেলে পারভেজ মিয়া থেকে পারভেজ হাসান আবির হলেও টিকটক আইডি ও ইউটিউব আইডিতে পরিচয় দেন কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা হিসেবে।

বাংলাদেশের বেসরকারি ব্যাংক দ্যা সিটি ব্যাংক লিমিটেডে আবির টি হাজউ, এসি নং -১২৫৩৮০৩৮১০০০১ ও পারভেজ হাসান আবির যার এসি নং – ২৩০৩২১৪১৮৬০০১ নামে দুইটি ব্যাংক একাউন্টে টাকা নিতো সে। তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হওয়া ব্যক্তিরা ফেসবুকে ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করলে সে তার ইউটিউব আইডি থেকে নিজেকে ফকিন্নীর পোলা না বলে দাবি করেন ও দেশে তার দুইটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে বলে দাবি করেন। এছাড়া তিনি ৪০ চল্লিশটিরও বেশি দেশে ঘুরেছেন বলে জানান। পারভেজ হাসান আবিরের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন