
ওসমান গনি, চান্দিনা প্রতিনিধি
১৯৭১ সালের রক্তঝরা সেই দিনগুলোতে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল ১২ ডিসেম্বর। এটি চান্দিনাবাসীর জন্য এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও গর্বের দিন, যা প্রতি বছর 'চান্দিনা মুক্ত দিবস' হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপিত হয়। জাতীয়ভাবে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালিত হলেও, চান্দিনাবাসীর কাছে ১২ ডিসেম্বর এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ডিসেম্বরের শুরুতে কুমিল্লা অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অভিযান জোরদার হয়। তারই ধারাবাহিকতায় পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানা হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একটি কাঠের সেতু মাইন বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে ময়নামতি সেনানিবাসে মিত্রবাহিনীর শেলিংয়ের কারণে ১১ ডিসেম্বর ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সেনানিবাস ছেড়ে বরুড়া হয়ে চান্দিনার দিকে পালাতে শুরু করে। পালানোর সময় তারা বিভিন্ন স্থানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই খবর চান্দিনার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছালে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় তারা দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে পাকিবাহিনীকে প্রতিহত করতে এগিয়ে যান। ১১ ডিসেম্বর দুপুরে উপজেলা সদরের হারং উদালিয়ার পাড় এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তুমুল গোলাগুলির পর একপর্যায়ে পাকবাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়।
এর ফলস্বরূপ, ১২ ডিসেম্বর ভোরে প্রায় ১৭ শতাধিক পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। উল্লাসিত মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে ধরে এনে বর্তমান চান্দিনা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জড়ো করেন। তবে এই বিজয়ের পথ ছিল রক্তে ভেজা। ১১ ডিসেম্বর হারং উদালিয়া এলাকা থেকে পালিয়ে যাওয়া ৬ জন পাকবাহিনীকে করতলা গ্রামের একটি কেওড়াতলায় মুক্তিকামী জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা আটক করার সময় গুলি চালালে ২ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৪ জন মুক্তিকামী জনতা শহীদ হন। দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে চান্দিনাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। চান্দিনার স্মৃতিসৌধ ফলকে মোট ১৩ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম খচিত আছে। রক্তক্ষরা এই দিনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা চান্দিনাতে উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পতাকা। বিজয়ের আনন্দ আর স্বজন হারানোর বেদনার এক মিশ্র অনুভূতিতে চান্দিনার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল সেদিন।
চান্দিনা মুক্ত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছরই নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এ বছরও উপজেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে দিনটি পালনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকালে চান্দিনা উপজেলা পরিষদ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে বর্ণাঢ্য বিজয় র্যালি, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে আলোচনা সভা এবং শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। চান্দিনা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী আবদুল মালেক জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগে চান্দিনাবাসী আজও গর্বিত এবং এই দিবসটি নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সম্পাদক : শাদমান আল আরবী | নির্বাহী সম্পাদক : তানভীর আল আরবী
ঠিকানা : ঝাউতলা, ১ম কান্দিরপাড়, কুমিল্লা-৩৫০০। ফোন : ০১৩১৬১৮৬৯৪০, ই-মেইল : [email protected], বিজ্ঞাপন: [email protected], নিউজরুম: [email protected] © ২০২৩ রাইজিং কুমিল্লা সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত। | Design & Developed by BDIGITIC