বুধবার ৮ অক্টোবর, ২০২৫

অ্যানথ্রাক্স ঠেকাতে মাঠে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, টিকাদান ও জরুরি সতর্কতা জারি

নিজস্ব প্রতিবেদক

Rising Cumilla - Anthrax
অ্যানথ্রাক্স একজন ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হতে পারে/প্রতীকি ছবি/সংগৃহীত

রংপুর ও গাইবান্ধা জেলায় গবাদিপশুর মধ্যে অ্যানথ্রাক্স রোগ ছড়িয়ে পড়ায় (বাংলায় যা তড়কা নামে পরিচিত) প্রাণিসম্পদ অধিদফতর জরুরি ভিত্তিতে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। এটি একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ যা পশু থেকে মানুষের শরীরেও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই রোগটি ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ এবং জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয় করে মাঠপর্যায়ে জোরালো টিকাদান ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

অধিদফতর রংপুর ও গাইবান্ধাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করে কার্যক্রম জোরদার করেছে।

প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এলআরআই এ অঞ্চলে ৩০ লাখ টিকা সরবরাহের পরিকল্পনা নিয়েছে, যার মধ্যে শুধুমাত্র রংপুর ও গাইবান্ধা জেলাতেই পাঠানো হবে প্রায় ২০ লাখ টিকা। ইতোমধ্যে রংপুর জেলার আটটি উপজেলায় এক লাখ ৬৭ হাজার গরুকে অ্যানথ্রাক্স টিকা দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ২৬ হাজার ৪০০ গরুতে টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে।

রোগের সংক্রমণ রোধে জরুরি ভিত্তিতে অসুস্থ পশু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কসাইখানাগুলোতে পশু স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য ৩৬টি মেডিকেল টিম মোতায়েন করা হয়েছে।

পাশাপাশি, রংপুরের মিঠাপুকুর, পীরগাছা ও কাউনিয়ায় টিকাদান কাজের জন্য ৩২টি আলাদা টিম মাঠে কাজ করছে।

আক্রান্ত এলাকায় মৃত পশু গভীরভাবে মাটিচাপা দেওয়া এবং খোলা জায়গা বা পানিতে না ফেলার জন্য জনগণকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। লিফলেট বিতরণ, উঠান বৈঠক, এবং মাইকিংয়ের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে একটি ঘটনায় ১৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে।

‘ওয়ান হেলথ’ কর্মসূচির আওতায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যৌথভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। জনগণকে অসুস্থ পশু জবাই না করা এবং যেকোনো পশুর অসুস্থতার ক্ষেত্রে দ্রুত স্থানীয় ভেটেরিনারি হাসপাতাল অথবা প্রাণিসম্পদ অফিসে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এদিকে সংক্রমণের প্রকৃত উৎস অনুসন্ধানে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত দল রংপুর ও গাইবান্ধা পরিদর্শন করেছে এবং তারা শিগগিরই একটি প্রতিবেদন দাখিল করবে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এ পর্যন্ত সংগ্রহ করা ১১টি রক্ত নমুনার সবগুলো নেগেটিভ এলেও ১১টি মাংস নমুনার মধ্যে ১০টিতেই অ্যানথ্রাক্স পজেটিভ পাওয়া গেছে।

কর্তৃপক্ষ মনে করে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ অধিদফতর, স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসে অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।

অ্যানথ্রাক্স (তড়কা) রোগ থেকে সুস্থ থাকতে যা জানা জরুরি:

অ্যানথ্রাক্স, যা বাংলায় তড়কা রোগ নামে পরিচিত, হলো তীব্র ও গুরুতর সংক্রামক রোগ। এটি ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস ব্যাকটেরিয়ার কারণে শরীরে বাসা বাঁধে। রোগটি মূলত গবাদিপশুতে দেখা গেলেও সংক্রমিত পশু বা তাদের পণ্য (যেমন: চামড়া, পশম, মাংস) থেকে মানুষও আক্রান্ত হতে পারে।

মানবদেহে সংক্রমণের পদ্ধতি

মানুষ সাধারণত তিনভাবে অ্যানথ্রাক্স ব্যাকটেরিয়ায় সংক্রমিত হতে পারে:

১. ত্বকের মাধ্যমে: সংক্রমিত পশুর চামড়া বা পশম স্পর্শ করলে।

২. শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে: স্পোরযুক্ত বাতাস ফুসফুসে প্রবেশ করলে।

৩. খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে: সংক্রমিত পশুর মাংস খেলে।

অবশ্য অন্যান্য বায়ুবাহিত রোগের মতো মানুষের হাঁচি-কাশির মাধ্যমে অ্যানথ্রাক্স ছড়ায় না। ত্বকে কোনো ক্ষত থাকলে সেই ক্ষত দিয়ে ঢুকে যেতে পারে অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু।

অ্যানথ্রাক্স রোগের উপসর্গ

সংক্রমণের ধরণের ওপর নির্ভর করে উপসর্গ ভিন্ন হতে পারে:

  • ত্বকের অ্যানথ্রাক্স: প্রাথমিক অবস্থায় চুলকানিযুক্ত বাম্প, পরবর্তীতে ব্যাথাহীন কালো আলসার তৈরি হয়। এর সঙ্গে জ্বর ও মাথাব্যথা হতে পারে।
  • শ্বাসনালী/ফুসফুসের অ্যানথ্রাক্স: ফ্লু-সদৃশ লক্ষণ, যেমন: জ্বর, কাশি, পেশী ব্যথা দিয়ে শুরু হয়। গুরুতর হলে শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যথা দেখা দেয়।
  • পরিপাকতন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স: বমি, জ্বর, পেটে ব্যথা হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে রক্তাক্ত ডায়রিয়া ও অন্ত্রের প্রদাহ হতে পারে।

প্রতিরোধ ও করণীয়

এই মারাত্মক রোগের সংক্রমণ রোধের প্রধান হাতিয়ার হলো সচেতনতা ও সতর্কতা অবলম্বন।

  • পশুদের নিয়মিত অ্যানথ্রাক্স টিকা দেওয়া নিশ্চিত করা।
  • সংক্রমিত পশু বা মৃত পশুর সংস্পর্শ সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে চলা।
  • আক্রান্ত পশুর জবাই বন্ধ রাখা।
  • মৃত পশু মাটির গভীরে পুঁতে সৎকার করা (খোলা জায়গায় বা পানিতে ফেলা যাবে না)।
  • মৃত পশু সৎকারের সময় গ্লাভস ও অন্যান্য সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার করা।
আরও পড়ুন