বুধবার ৬ আগস্ট, ২০২৫

অফলাইন রাইড: নিরাপত্তাহীন যাত্রা ও আইনি ঝুঁকি ভরপুর

অফলাইন রাইড: নিরাপত্তাহীন যাত্রা ও আইনি ঝুঁকি ভরপুর
অফলাইন রাইড: নিরাপত্তাহীন যাত্রা ও আইনি ঝুঁকি ভরপুর/ছবি: প্রতিনিধি

দেশজুড়ে অনলাইন রাইড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রসারের পাশাপাশি কিছু চালক ও যাত্রী এখনো “অফলাইন রাইড”-এর আশ্রয় নিচ্ছেন, যেখানে কোনো অ্যাপ বা ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহার ছাড়াই যাতায়াত সম্পন্ন হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পদ্ধতি যেমন অনিয়ন্ত্রিত, তেমনি যাত্রী ও চালক উভয়ের জন্যই নানা ধরনের নিরাপত্তা ও আইনি ঝুঁকি তৈরি করছে ।

বাংলাদেশের বাইক রাইড শেয়ারিং অ্যাপগুলো জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর, অনেক বাইক রাইডারই বেশি ইনকামের লোভে শুরু করেছেন অফলাইন রাইড। ব্যস্ততার কারণে অনেক সাধারণ মানুষই সহজলভ্য এই রাইডগুলো বেছে নেন। আর এভাবেই সম্পূর্ণ অপরিচিত রাইডারদের সাথে রাইড নিয়ে বেশিরভাগ মানুষই নানান ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।

সম্প্রতি কিছু অফলাইন রাইড ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কোনো ট্র্যাক করার উপায় না থাকায় খুব সহজেই ইউজারকে ভুলপথে নিয়ে ছিনতাই করার সুযোগ পেয়ে যান রাইডাররা। এসব রাইডারদের বেশিরভাগই লাইসেন্স ছাড়া বাইক চালান যার কারণে এদের পরবর্তীতে খুঁজে বের করাও কঠিন হয়ে পড়ে।

এমনও দেখা গেছে ডাকাতি করার জন্য ঢাকার বাইরে থেকে বাইক ভাড়া করে এনে অফলাইনে রাইড দেন অনেক রাইডার। ঠিক একইভাবে অনেক রাইডার সঠিক রাস্তা না চেনা থাকায়, ইউজার রাইডারকে নির্জন জায়গায় নিয়ে যেয়ে বিভিন্ন অপকর্ম করে থাকেন।

গত ৪ই জুন এক ভয়ানক ঘটনা ঘটে, যেখানে একজন নারী অফলাইনে মোটরসাইকেলে ওঠার পর ধর্ষণের শিকার হন। ওই নারী একটি বিউটি পার্লারে কাজ করতেন এবং সেদিন গন্তব্যে পৌঁছাতে চালকের সঙ্গে চুক্তি করে একটি মোটরসাইকেলে উঠেছিলেন।

তার অভিযোগ অনুযায়ী, বাইকে ওঠার কিছু সময় পরই তিনি জ্ঞান হারান এবং রাত ৯টা পর্যন্ত অচেতন অবস্থায় ছিলেন। জ্ঞান ফিরে পান ঢাকার বাইরে একটি মহাসড়কে, যেখানে তিনি ধর্ষণের শিকার হন বলে জানান। পরে তিনি জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করলে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে।

তারজুয়ানা নামে এক শিক্ষিকা সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে বাসা থেকে বের হন। সকাল ৮টার দিকে তিনি উত্তরা পশ্চিম থানাধীন ৫ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে পৌঁছলে পেছন থেকে একটি মোটরসাইকেলে আসা হেলমেটধারী দুই ব্যক্তি তার রিকশার গতি রোধ করে। এ সময় ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে শিক্ষিকার ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মাত্র ৩৪ সেকেন্ডের এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই নারীর কাছ থেকে শাওমী ব্র্যান্ডের মোবাইল সেট, দেড় ভরি উজনের স্বর্ণের চেইন ও ৩ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় বলে তিনি জানিয়েছেন। পরে মোটরসাইকেলটি ৫ নম্বর সেক্টরের কল্যাণ সমিতির রাস্তার দিকে চলে যায়। এতে ওই নারী প্রচণ্ড ভয় পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। পরে ওইদিন স্কুলে না গিয়ে তিনি বাসায় ফেরেন। এ ঘটনায় ওই নারীর স্বামী রুহুল আমীন উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন। ঘটনার পর বিষয়টি ব্যাপক সমালোচিত হওয়ায় ছায়া তদন্ত শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।

এমনই একটি ঘটনার ঘটে পূর্বাচল ১০ নম্বর সেক্টর। একজন যাত্রী অফলাইনে রাইড নিয়ে পূর্বাচলের খানিকটা ভিতর দিকে যান। তারপর বাইক ছিনতাই করার জন্য যাত্রী রাইডারের চোখে পেছন থেকে মরিচে গুঁড়া ছিটিয়ে দেন। এসময় রাইডার চিৎকার করা শুরু করলে আশেপাশে মানুষ জড়ো হয়ে যায়।

পরবর্তীতে পূর্বাচল ১০ নম্বর সেক্টর খান বাড়ির চত্বর থেকে সেই ছিনতাইকারী যাত্রীকে আটক করেন জনগণ। এরকম অনিশ্চিত ঘটনার সময় রাইডার বা যাত্রী কেউই সাহায্য চাওয়ার মতো অবস্থায় থাকেন না।

সূত্রমতে, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ঢুকে পড়েছে ছিনতাইকারী চক্র। তারা বাইক রাইড শেয়ারিং এর মতো প্রতিষ্ঠানে নিবন্ধন করলেও অ্যাপসের মাধ্যমে যাত্রী পরিবহণ করছে না। অ্যাপসের মাধ্যমে রিকোয়েস্ট পাঠালে গ্রহণ করেন না।

আবার অনেক সময় তারা কোথায় যাবেন এবং ভাড়ার পরিমাণ জেনে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তবে যাত্রীকে তারা টার্গেট করে রাখেন। কিছুক্ষণ পর তারা ওই অ্যাপস বন্ধ করে ওই যাত্রীর লোকেশন অনুযায়ী আসেন এবং চুক্তিতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।

এমনকি অ্যাপসের থেকেও কম ভাড়ায় যাওয়ার অফার দেন। এতে যাত্রীরাও লোভে পড়ে ওই চালকের মোটরসাইকেলে চড়ে বসেন। এরপরই বিপদে পড়েন যাত্রীরা।

অ্যাপের বাইরে যাচাই-বাছাই ছাড়া অপরিচিত রাইডার ও যাত্রীর সাথে যাতায়াত করা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তা আবারও প্রমাণ করে দিয়েছে এরকম ভয়াবহ ঘটনাগুলো। অফলাইন রাইডে না থাকে কোনো ট্র্যাকিং, না কোনো নিরাপত্তা কভারেজ, না-ই থাকে রাইডারের প্রোফাইল বা রেটিং দেখার সুযোগ।

ফলে অপরাধপ্রবণ বা অনভিজ্ঞ রাইডারের সঙ্গে যাত্রী অনায়াসেই ঝুঁকির মুখে পড়ে যান। দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ মেলে না, আর নির্ধারিত ভাড়া না থাকায় রাইড শেষে প্রায়ই রাইডার ও যাত্রীর মধ্যে তর্ক বা বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, অফলাইন রাইডের কোনো হিসাব না থাকায় রাইডাররা সহজেই ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারেন, যা সরকারের রাজস্ব ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়ায়।

জানা গেছে, রাজধানীতে এখন ৬ লাখেরও ওপর বাইকার (চালক) রাইড শেয়ার করছেন। গত বছরেই শুধু ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৫৪টি মোটরসাইকেল। বাইরে থেকেও ঢুকছে অনেক মোটরসাইকেল।

পাঠাওয়ের হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে তাদের আড়াই লাখের মতো বাইকার আছেন, যার বড় অংশ ঢাকায়। এছাড়া উবার, ওভাই, ও-বোন, সহজসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান রাইড শেয়ারের সুবিধা দিচ্ছে।

এগুলোর অধিকাংশই ঢাকাকেন্দ্রিক। সহজে কাজের সুযোগ মেলায় প্রতিদিন রাইড শেয়ার করতে রাজধানীতে পাড়ি জমাচ্ছে অসংখ্য নতুন মুখ। এসবের সঙ্গে রাইড শেয়ারিংয়ে প্রতিনিয়ত যোগ হচ্ছে নানা অপরাধের অভিযোগ।

২০১৭ সালে ঢাকার রাস্তায় চলমান গাড়িতে নারী যাত্রীর সামনে উবার চালকের অশ্লীল আচরণ, চট্টগ্রামে উবার চালিত গাড়িতে তরুণী ধর্ষণ, উবার চালকের বেপরোয়া ড্রাইভিংয়ের কারণে রাজধানীতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীর মৃত্যু, মাদক বহনের অভিযোগে পাঠাও চালক আটক থেকে ছিনতাইয়ের অভিযোগ প্রশ্নের মুখে ফেলেছে রাইড শেয়ারকে।

আরও পড়ুন