জানুয়ারি ৬, ২০২৫

সোমবার ৬ জানুয়ারি, ২০২৫

অটোমান তুর্কিদের কৌশল ব্যবহার করে যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো মুঘল সাম্রাজ্য

ছবি: সংগৃহীত

জহিরউদ্দীন বাবর ভালো করেই জানতেন, তার সেনাবাহিনীর সংখ্যা শত্রুবাহিনীর তুলনায় অনেক কম, তাই তিনি এমন একটি পদক্ষেপ নেন, যা ইব্রাহিম লোদী কল্পনাও করতে পারেননি।

বাবর ছিলেন মধ্য এশিয়ার মুসলিম সম্রাট ও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পানিপথের প্রথম যুদ্ধে লোদী বংশের শেষ সুলতান ইব্রাহীম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লী দখল করে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর সেই পানিপথের যুদ্ধে অটোমানদের যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করেছিলেন তিনি।

অটোমানদের যুদ্ধ কৌশল

অটোমানদের যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী, বাবরের সেনাবাহিনী যুদ্ধের ময়দানে প্রথম সারিতে চামড়ার দড়ি দিয়ে প্রায় সাতশ গরুর গাড়ি বাঁধেন। তাদের পেছনেই বসানো হয় কামান। বলে রাখা ভালো, এটি ছিল পানিপথের প্রথম যুদ্ধ এবং এর আগে ভারতের কোনো যুদ্ধে কামানের ব্যবহার হয়নি। কামানের বিষয়ে অনেকে তখন জানতোই না।

শুরুর দিকে এই কামানগুলোর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতা খুব একটা ভালো ছিল না। তবে বাবরের সেনাবাহিনী কামান থেকে নির্বিচারে গোলাবর্ষণ শুরু করলে এর আকস্মিক বিস্ফোরণ ও ধোঁয়ায় আফগান বাহিনী বিভ্রান্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে শুরু করে। অথচ ইব্রাহীম লোদীর বাহিনীতে ৫০ হাজার সেনা ছাড়াও এক হাজারের মতো যুদ্ধ হাতি বা গজবাহিনী ছিল, কিন্তু সেনাদের মতো এই হাতিগুলোও আগে কখনো কামানের বিস্ফোরণ শোনেনি। এ কারণে কামান থেকে গোলা বিস্ফোরণের সাথে সাথে হাতিগুলো যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পরিবর্তে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, ধোঁয়ায় সবার শ্বাসরোধ হয়ে আসে। অন্যদিকে বাবরের ১২ হাজার প্রশিক্ষিত অশ্বারোহী বাহিনী এমন মুহূর্তের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারা বিদ্যুতের গতিতে এগিয়ে গিয়ে লোদীর সেনাবাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং বাবরের বিজয় সুনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

ইতিহাসবিদ পল কে. ডেভিস তার ‘হান্ড্রেড ডিসাইসিভ ব্যাটেলস’ বইটিতে এই যুদ্ধকে ইতিহাসের সবচেয়ে ভাগ্য নির্ধারণী যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সেই থেকেই মহান মুঘল সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল। অটোমান বা উসমানীয় যুদ্ধ কৌশল ছাড়াও বাবরের ওই যুদ্ধে দুই তুর্কি গোলা নিক্ষেপকারী ওস্তাদ আলী ও মুস্তফা এই বিজয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। বাবরকে অটোমান সামাজ্যের প্রথম খলিফা সেলিম তার ওই দুই সেনাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি, অটোমান সাম্রাজ্য ১৩ শতকের শেষদিকে উসমান গাজীর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় এবং আনাতোলিয়া অনেক ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য বর্তমান ইতালি, গ্রিস ও তুরস্ক এবং উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত ছিল। অন্যদিকে আনাতোলিয়া হচ্ছে বর্তমান তুরস্কের বড় একটি অংশ। উসমান গাজী, ১২৫৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সোগুত নামে ছোট একটি সেলজুক রাজ্যের তুর্কি সেনাপতি ছিলেন তিনি। একদিন তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, তিনি পৃথিবীর ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেবেন।

উসমান গাজীর স্বপ্ন

ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ক্যারোলিন ফিঙ্কেল তার ‘উসমানস ড্রিম’ বইতে লিখেছেন, উসমান এক রাতে শেখ আদিবালি নামে এক বৃদ্ধ দরবেশের ঘরে ঘুমিয়ে ছিলেন। ওই রাতে উসমান স্বপ্ন দেখেন, তার বুক থেকে একটি বিশাল গাছ বেরিয়ে ডালপালা ছড়াচ্ছে এবং সারাবিশ্বে ছায়া ফেলছে। উসমান পরে শেখ আদিবালির কাছে তার এই স্বপ্নের কথা জানান। শেখ আদিবালি এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন ‘হে উসমান, বাবা আমার, ধন্য হও, আল্লাহ্ তোমাকে এবং তোমার বংশধরদের কাছে রাজকীয় সিংহাসন অর্পণ করেছেন।’

এই স্বপ্নটি উসমান গাজীর জন্য একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তিনি সৃষ্টিকর্তার সমর্থন পেয়েছেন। তারপর আনাতোলিয়ার বেশিরভাগ অংশ জয় করে, আশপাশের সেলজুক ও তুর্কমান রাজ্যসহ বাইজান্টাইন অনেক অঞ্চল দখল করে নেন। উসমানের স্বপ্নটি পরে অটোমান সাম্রাজ্যের যৌক্তিকতা এবং একই সাথে মিথ বা পৌরাণিক কথায় পরিণত হয়।

এই অটোমান সাম্রাজ্য প্রায় ৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসন করেছে। এমন দীর্ঘসময় ধরে তারা কেবল আনাতোলিয়া নয়, বরং তিনটি মহাদেশের বিশাল অংশ শাসন করে গেছে। উসমানের উত্তরসূরিরা ইউরোপের দিকে নজর দেয়। তারা ১৩২৬ সালে গ্রিসের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর থেসালোনিকি জয় করে। এরপর ১৩৮৯ সালে সার্বিয়া জয় করে। কিন্তু তাদের সবচেয়ে বড় ও ঐতিহাসিক বিজয় ছিল ১৪৫৩ সালে। ওই বছর তারা বাইজান্টাইন রাজধানী কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয় করে।

মুসলিমরা এর আগে প্রায় ৭০০ বছর ধরে এই শহরটি দখলের চেষ্টা করলেও এটির ভৌগোলিক অবস্থান এমন ছিল, তারা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। কনস্টান্টিনোপলের তিনদিক বসফরাস প্রণালি বেষ্টিত হওয়ায় এই শহরটি আশ্রয়ের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। বাইজান্টাইনরা গোল্ডেন হর্ন পথটি বন্ধ করে রেখেছিল। তাদের ২৮টি যুদ্ধজাহাজ অন্যদিকে পাহারা দিতো। গোল্ডেন হর্ন হচ্ছে বসফরাস প্রণালির সরু এক অংশ, যা ছিল ইস্তাম্বুল শহরের প্রধান জলপথ।

উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মেহমেদ ১৪৫৩ সালের ২২ এপ্রিল এমন এক পদক্ষেপ নেন, যা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। তিনি মাটিতে তক্তা বিছিয়ে একটি সড়ক তৈরি করেন এবং তেল ও ঘি মিশিয়ে রাস্তাটিকে খুব পিচ্ছিল করে ফেলেন। তারপর গবাদি পশুর সহায়তায় তার ৮০ টি জাহাজকে এই পথে টেনে নিয়ে যান এবং এভাবে সহজেই ওই শহরের বিস্মিত প্রহরীদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। বিজয়ী হয়ে মেহমেদ তার রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে স্থানান্তর করেন এবং তাকে ‘সিজার অব রোম’ (রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা) উপাধি দেওয়া হয়।

প্রথম উসমানীয় খলিফা

এরপর বিজয়ী মেহমেদের নাতি ‘প্রথম সেলিম’ অন্যান্য দিকে দৃষ্টিপাত করেন। তিনি ১৫১৬ ও ১৫১৭ সালে মিসরের মামলুকদের পরাজিত করেন, মিসর ছাড়াও বর্তমান ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডানসহ সর্বোপরি হিজাজ প্রদেশ জয় করে তার সাম্রাজ্যের আকার দ্বিগুণ বাড়িয়ে ফেলেন। এর পাশাপাশি আজ থেকে ঠিক প্রায় ৫০০ বছর আগে হিজাজের দুটি পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনা অধিগ্রহণ করে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক হয়েছিলেন প্রথম সেলিম।

ধারণা করা হয়, উসমানীয় খিলাফত ১৫১৭ সালে শুরু হয়েছিল এবং প্রথম সেলিমকে প্রথম খলিফা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার আগ পর্যন্ত উসমানীয়দের ‘সুলতান’ বা ‘বাদশাহ্‌’ বলা হতো। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার ‘ইস্যু অফ খিলাফত’ বইতে লিখেছেন, ‘সুলতান প্রথম সেলিম খানের সময় থেকে আজ পর্যন্ত অটোমান সুলতানরা সব মুসলমানের খলিফা ও ইমাম ছিলেন। এই চার শতাব্দীর মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে খিলাফতের দাবিদারও ওঠেনি। সরকারের কাছে শত শত খলিফা দাবিদার উঠেছে ঠিকই, কিন্তু কেউ ইসলামের কেন্দ্রীয় খিলাফত দাবি করতে পারেনি।’

প্রথম সেলিমের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি অল্প সময়ের মধ্যে একের পর এক সাম্রাজ্য দখল করতে পারতেন। এর বড় কারণ ছিল তার কার্যকর যুদ্ধ কৌশল। পানিপথের যুদ্ধে তার এই রণকৌশল অনুসরণ করে ওই যুদ্ধে প্রথম গোলাবারুদ ব্যবহার করেন সম্রাট বাবর। ওই যুদ্ধে ইব্রাহীম লোদীকে হারানোর পরই মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাবর।

সম্রাট হুমায়ুন বনাম অটোমান খলিফা

বাবরের উত্তরসূরি হুমায়ুনও অটোমানদের এই অনুগ্রহের কথা স্বরণ রেখেছিলেন। সেলিমের ছেলে সালমান আলিশানকে লেখা একটি চিঠিতে হুমায়ুন লেখেন ‘খিলাফতের মর্যাদার ধারক, মহানতার স্তম্ভ, ইসলামের ভিত্তির রক্ষক সুলতানের জন্য শুভকামনা। আপনার নাম সম্মানের সিলমোহরে খোদাই করা হয়েছে এবং আপনার সময়ে খিলাফত নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। মহান আল্লাহ্ যেন আপনার খিলাফত অব্যাহত রাখেন।’

হুমায়ুনের ছেলে আকবর অবশ্য উসমানীয়দের সাথে কোনো সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেননি। যার কারণ সম্ভবত এই, ইরানের সাফাভিদ শাসকদের সাথে অটোমানরা তখন ক্রমাগত যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং আকবর সাফাভিদ শাসকদের ক্ষেপাতে চাননি। তবে আকবরের উত্তরসূরি শাহজাহান ও আওরঙ্গজেবের অটোমান সুলতানদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল। উপহার বিনিময় আর কূটনৈতিক মিশন তাদের মধ্যে সাধারণ বিষয় ছিল এবং তারা তাকে সব মুসলমানের খলিফা বলে মনে করতেন।

শুধু মুঘলরা নয়, অন্য ভারতীয় শাসকরাও অটোমানদের তাদের খলিফা হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং ক্ষমতায় আসার পর তাদের কাছ থেকে আনুগত্য নেওয়া জরুরি বলে মনে করতেন। টিপু সুলতানও মহীশুরের শাসক হওয়ার পর তৎকালীন অটোমান খলিফা তৃতীয় সেলিমের কাছ থেকে তার শাসনের জন্য সমর্থন চাইতে কনস্টান্টিনোপলে একটি বিশেষ প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিলেন। তৃতীয় সেলিম টিপু সুলতানকে তার নাম সংবলিত একটি টাকশাল করতে এবং শুক্রবারের খুতবায় তার নাম পাঠ করার অনুমতি দেন। তবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য টিপু সুলতান যখন সামরিক সহায়তা চেয়েছিলেন, তখন অটোমান খলিফা সেই অনুরোধ গ্রহণ করেননি। কারণ সেই সময় তিনি নিজেই রাশিয়ানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবং তখন শক্তিশালী ব্রিটিশ শত্রুদের পরাস্ত করা বেশ কঠিন হতো।

কানুনি সুলতান সুলেমান

অটোমানরা শুরুতে ইউরোপের অনেক অঞ্চল দখল করে। তবে এই সাম্রাজ্য রাজনীতি, রণনীতি, অর্থনীতি এই তিনটি ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রসার লাভ করে প্রথম সুলেমানের আমলে। তিনি ১৫২০ থেকে ১৫৬৬ সাল পর্যন্ত টানা ৪৭ বছর আমৃত্যু শাসনভারে ছিলেন। সুলেমান খানের শাসনামলে অটোমান সাম্রাজ্য তার সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শৌর্যের শীর্ষে উঠেছিল। এ কারণে তিনি পশ্চিম ইউরোপে ‘সুলেমান দ্য মেগনিফিসেন্ট’ নামে পরিচিতি। অন্যদিকে, নিজ সাম্রাজ্যে তাকে বলা হতো ‘কানুনি সুলেমান’। বেলগ্রেড ও হাঙ্গেরি জয় করে সুলতান সুলেমান তার সাম্রাজ্যের সীমানা মধ্য ইউরোপ পর্যন্ত প্রসারিত করেছিলেন। তবে দু’বার চেষ্টা করেও অস্ট্রিয়ার শহর ভিয়েনা জয় করতে পারেননি।

 ইরফান ইবনে আমিন পাটোয়ারী

লেখক: শিক্ষার্থী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।