
প্রতিবছর ৫ই জুন পালন করা হয় “বিশ্ব পরিবেশ দিবস”। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে শুরু হওয়া এই দিবসটি মনে করিয়ে দেয়; আমাদের অস্তিত্বের সাথে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক এবং পৃথিবীর ভবিষ্যৎ আমাদের আজকের কর্মপরিকল্পনার ওপর কতটা নির্ভরশীল।
পরিবেশ শুধু একটি ধারণা নয়; এটি একটি বাস্তবতা, যার পরিবর্তনের সাথে আমাদের সমাজ, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং সংস্কৃতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই পরিবর্তনের সবচেয়ে গভীর ও ভয়ংকর রূপ হলো জলবায়ু পরিবর্তন, যা আজ বিশ্বব্যাপী এক উদ্বেগজনক সংকট হিসেবে বিবেচিত।
জলবায়ু পরিবর্তন কেবল তাপমাত্রা বৃদ্ধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রভাবে দেখা যাচ্ছে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ; বন্যা, খরা, সাইক্লোন, হিমবাহ গলন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং কৃষিজ উৎপাদনের বিপর্যয়। দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঘনবসতিপূর্ণ ও দুর্যোগপ্রবণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই সংকটের অন্যতম অংশীদার।
উপকূলীয় অঞ্চলগুলো লবণাক্ততার কারণে জমি সমূহ কৃষির জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে, নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, হারাচ্ছে তাদের বসতভিটা ও জীবিকা। এর ফলে জলবায়ুজনিত কারণে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে এবং শহরমুখী অভিবাসন প্রবণতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা নগর জীবনে চাপ সৃষ্টি করছে।
বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের জন্য মূলত দায়ী উন্নত রাষ্ট্রগুলো। তারা শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে পৃথিবীর পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে। তবে এর চরম মূল্য দিতে হচ্ছে তুলনামূলকভাবে কম কার্বন নিঃসরণকারী ও কার্বন নিঃসরণ না করা দেশগুলোকে।
এই বৈষম্য বিশ্ব জলবায়ুর প্রেক্ষাপটে ন্যায়ের প্রশ্ন তুলে ধরে। যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের প্রতিটি মানুষই কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তথাপিও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এই ক্ষতির মাত্রা বহুগুণ বেশি।
বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন শুধু একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়; এটি একাধিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে বৈশ্বিক নিরাপত্তা সংকটে পরিণত হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা, পানির প্রাপ্যতা, স্বাস্থ্যসেবা, মানবাধিকার, এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা; সব কিছুই এর সাথে জড়িত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টিকে থাকার জন্য আজকের দিনে আমাদের নিতে হবে বাস্তবমুখী, বিজ্ঞানসম্মত এবং নৈতিক পদক্ষেপ।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের করণীয় কী?
প্রথমত, আমাদেরকে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে পরিবেশবান্ধব জীবন-যাপন চর্চা করা জরুরি। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
প্লাস্টিক বর্জ্য হ্রাস, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণের ব্যবহার বৃদ্ধি, জলাধার সংরক্ষণ এবং বৃক্ষরোপণ; এইসব ছোট ছোট উদ্যোগই গড়ে তুলতে পারে বড় পরিবর্তনের ভিত্তি। শহর অঞ্চলে পরিকল্পিত নগরায়ণ ও সবুজ স্থানের সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরি।
শিক্ষা ক্ষেত্রেও পরিবেশ বিষয়ক শিক্ষা অন্তর্ভুক্তি ও সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। শিশুদের ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতিপ্রেম ও দায়িত্ববোধ শেখানো হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি টেকসই পৃথিবী নির্মাণে অবদান রাখতে পারবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমেও পরিবেশ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, সরকার ও নীতি-নির্ধারকদের উচিত পরিবেশবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আন্তরিকতা দেখানো। উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিল্প ও কৃষি খাতে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করতে হবে।
বনায়ন, নদী সংরক্ষণ ও জলাভূমি রক্ষায় দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জলবায়ু তহবিল পাওয়ার জন্য কার্যকর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন ও অভিযোজন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়।
তৃতীয়ত, আমাদের মনে রাখতে হবে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কেবল রাষ্ট্র বা বৈশ্বিক সংগঠন নয়, ব্যক্তি পর্যায়েও দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। প্রকৃতি আমাদের জীবনদাত্রী; এর ওপর একচ্ছত্র দখলদারিত্ব নয়, বরং এক আন্তরিক মেলবন্ধন ও সহাবস্থান গড়ে তোলার মনোভাব নিয়েই এগোতে হবে।
গাছ কাটার আগে প্রয়োজনে কয়েকবার ভাবতে হবে, নদী দখলের আগে বুঝতে হবে তার পরিণতি, যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলার আগে বিবেচনা করতে হবে তার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি কি হতে পারে।
এখন সময় এসেছে প্রকৃতির সাথে এক হয়ে কাজ করার, প্রযুক্তির ব্যবহার করে পরিবেশ রক্ষার, এবং বিজ্ঞান ও সচেতনতাকে ভিত্তি করে একটি পরিবেশবান্ধব সমাজ গঠনের।
জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের এই গ্রহের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমাদের সচেতনতা, দায়িত্ববোধ এবং যৌথ প্রচেষ্টার ওপর।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস কেবল একদিনের প্রতীকী আয়োজন নয়, বরং এটি হতে হবে আমাদের জীবনের প্রতিদিনের অঙ্গীকার। আসুন, প্রকৃতিকে ভালোবাসি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াই; কারণ এই পৃথিবীই আমাদের একমাত্র ঠিকানা।