
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সাম্প্রতিক শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (অনার্স) শেষ করা প্রতি তিনজন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন সর্বোচ্চ দুই বছর ধরে বেকার ছিলেন।
জরিপের বেকারত্বের সময়কাল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন (১৪.২৯%) এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত চাকরি পাননি।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, প্রতি ছয়জনের মধ্যে একজন (১৬.৬৭%) দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বেকারত্বের বোঝা টেনেছেন।
চলতি মাসে প্রকাশিত সরকারি এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে মোট ২৬.২৪ লাখ বেকার ছিল, যার মধ্যে ৮.৮৫ লাখই ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক।
চাকরি বিশেষজ্ঞরা স্নাতকদের এক-তৃতীয়াংশ বেকার থাকার বিষয়টিকে গুরুতর উদ্বেগজনক বলে মনে করেন। তাদের মতে, এই দীর্ঘমেয়াদি বেকারত্ব তরুণদের কর্মজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যারা এক থেকে দুই বছর দেরিতে কর্মজীবন শুরু করেন, তারা পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই পিছিয়ে থাকার ঝুঁকিতে থাকেন।
জেনেভায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থান খাতের সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম এই পরিস্থিতিকে ‘সম্পদের ভুল ব্যবহার’ বা ‘দক্ষতার অপ্রতুল ব্যবহার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মন্তব্য করেন, ছয় মাসের পরেও যদি কাজ না মেলে, সেটিই উদ্বেগজনক, যা স্পষ্টতই প্রতিভা ও সম্পদের অপচয়। তিনি মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদে এটি আরও বড় সমস্যা তৈরি করে।
এদিকে বিবিএস-এর প্রতিবেদনে চাকরিপ্রার্থীরা কীভাবে কাজ খুঁজছেন এবং সামগ্রিক শ্রমবাজারের অবস্থা কেমন—তা বিশদভাবে উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাকরিপ্রার্থীদের একটি বড় অংশ এখনও অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্কের ওপর নির্ভরশীল:
- প্রায় ৩৬ শতাংশ বেকার তরুণ প্রধানত আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের উপর নির্ভর করেছেন চাকরি খোঁজার জন্য।
- প্রায় ২৬ শতাংশ চাকরির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আবেদন করেছেন।
অন্যান্য উপায়ের মধ্যে রয়েছে:
- প্রায় ১২ শতাংশ সরাসরি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে যোগাযোগ করেছেন।
- ৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরাসরি আবেদন পাঠিয়েছেন।
- ৫.৫ শতাংশ শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন দেখার পর আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন।
- ৩.৫ শতাংশ চাকরির জন্য ‘ওয়াক-ইন ইন্টারভিউ’-এর চেষ্টা করেছেন।
আইএলও-এর সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা রিজওয়ানুল ইসলাম মনে করেন, আগে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া (যেমন—পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বা প্রতিষ্ঠানের ঘোষণা) থাকলেও, এখন বেশিরভাগ চাকরি অনুসন্ধান অনলাইনে চলে যাওয়ায় অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্কিংয়ের উপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে।
এই বেকারত্বের কারণ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, এটি আমাদের অর্থনীতির কঠিন বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। মূল কারণ হলো কর্মসংস্থান তৈরির জন্য আমাদের অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ হচ্ছে না।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষণা ফেলো বদরুন নেসা আহমেদ বলেন, শিক্ষার মানের দুর্বলতা ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের ঘাটতি অন্যতম কারণ। স্নাতকদের ক্ষেত্রে মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মান সত্যিই বড় পার্থক্য গড়ে দেয়।
বিবিএস-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি গত সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ না করে থাকেন বা অস্থায়ীভাবে কাজ থেকে বিরত থাকেন এবং বর্তমানে কাজের জন্য প্রস্তুত থাকেন কিংবা গত চার সপ্তাহে কাজ খুঁজে থাকেন বা ব্যবসা বা খামার শুরু করার চেষ্টা করে থাকেন, তবে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হয়।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে সপ্তাহে মাত্র এক ঘণ্টা কাজ করে বেঁচে থাকা কার্যত অসম্ভব। এছাড়া প্রায় এক কোটি মানুষ যারা পছন্দসই কাজ পাচ্ছেন না, তারা আংশিক বেকার বা ছদ্মবেশী বেকার হিসেবে শ্রেণিভুক্ত।