মঙ্গলবার ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

জরিপ: দেশের ৭৬% নারীই জীবনে অন্তত একবার সহিংসতার শিকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রতীকি ছবি/রাইজিং কুমিল্লা গ্রাফিকস

বাংলাদেশে প্রতি চারজন নারীর মধ্যে তিনজনই (৭৬ শতাংশ) তাদের জীবনে অন্তত একবার স্বামী বা জীবনসঙ্গী কর্তৃক শারীরিক, যৌন, মানসিক বা অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণও।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) কর্তৃক পরিচালিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’-এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

আজ (সোমবার) বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এই জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা গেছে, সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে তিনজনের মধ্যে দুজন (৬২ শতাংশ) কখনোই তা প্রকাশ করেননি—যা ক্ষতিকর সামাজিক রীতিনীতি ও ভয়ের পরিবেশের ইঙ্গিত বহন করে।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭৬ শতাংশ নারী জীবনে একবার স্বামী কর্তৃক যেকোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, অর্ধেকেরও বেশি নারী (৫৪ শতাংশ) তাদের জীবদ্দশায় স্বামীর দ্বারা শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন।

তবে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনও দেখা গেছে, সাম্প্রতিক (গত ১২ মাসে) স্বামী দ্বারা সহিংসতার সামগ্রিক প্রাদুর্ভাব ২০১৫ সালের ৬৬ শতাংশ থেকে কমে ২০২৪ সালে ৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে।

এছাড়াও, জরিপে নন-পার্টনার কর্তৃক সহিংসতার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে:

  • ১৫ বছর বয়স থেকে ১৫ শতাংশ নারী নন-পার্টনারের কাছ থেকে শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
  • ২.২ শতাংশ নারী নন-পার্টনার কর্তৃক যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। নন-পার্টনার কর্তৃক শারীরিক সহিংসতার ঘটনায় শাশুড়ি ও পুরুষ আত্মীয়রা সবচেয়ে বেশি জড়িত। অন্যদিকে, যৌন সহিংসতার অধিকাংশই পরিচিতজনদের (পুরুষ আত্মীয়, বন্ধু ও পরিচিতজন) দ্বারা সংঘটিত হয়েছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গর্ভকালীন সময়েও বিবাহিত নারীরা নিরাপদ নন। এ সময়ে:

  • ৭.২ শতাংশ নারী শারীরিক সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন।
  • ৫.৩ শতাংশ নারী যৌন সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছেন, যা মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।

অন্যদিকে, প্রযুক্তিনির্র্ভর জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতাও বাড়ছে। প্রায় ৮.৩ শতাংশ নারী প্রযুক্তির অপব্যবহারের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে যৌন ব্ল্যাকমেইল, ছবি নিয়ে অপব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ।

সহিংসতা মোকাবিলায় সহায়তা চাওয়ার হার অত্যন্ত কম উল্লেখ্য করে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, সহিংসতার শিকার মাত্র ১৪.৫ শতাংশ নারী চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। স্বামীর দ্বারা সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ৭.৪ শতাংশ আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন। এক্ষেত্রে তারা স্থানীয় নেতার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা চেয়েছেন।

নন-পার্টনার দ্বারা সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন মাত্র ৩.৮ শতাংশ, তবে তারা সবচেয়ে বেশি পুলিশের কাছ থেকে আইনি সহায়তা চেয়েছেন।

জরিপে আরও জানানো হয়,মাত্র ৪৮.৫ শতাংশ নারী জানেন যে কোথায় সহিংসতার অভিযোগ জানাতে হয় এবং ১২.৩ শতাংশ নারী সহিংসতার সহায়তাকারী হেল্পলাইন ১০৯ সম্পর্কে অবগত।

তাছাড়া, জরিপে উঠে এসেছে যে ভুক্তভোগী নারীদের চিকিৎসা ও আইনি সহায়তার জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়, যা তাদের নীরব থাকতে বাধ্য করে।

এছাড়া জরিপে স্বামী কর্তৃক সহিংসতা বাড়ার বা কমার পেছনে কিছু ঝুঁকি চিহ্নিত করে জানানো হয়, নারীর কম বয়স, যৌতুক প্রথা, স্বামীর মাদকাসক্তি বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক এবং শহুরে বস্তিতে বসবাস। স্বামীর উচ্চতর শিক্ষা। এবং নন-পার্টনার কর্তৃক সহিংসতার ক্ষেত্রে নারীর কম বয়স, সীমিত শিক্ষা এবং প্রতিবন্ধিতা প্রধান ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

জরিপটি নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। এতে সহিংসতা প্রতিরোধে জরুরি বিনিয়োগ, পরিষেবা শক্তিশালীকরণ এবং বিচার প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে জেন্ডার সমতা এবং মানবাধিকারের ভিত্তিতে একটি সহায়ক আইনি ও নীতিগত পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে নারীরা নির্ভয়ে সহিংসতা প্রকাশ করতে এবং আইনি প্রতিকার পেতে পারেন।

আরও পড়ুন