
মরুভূমির বুকে নীরবে ঘুরে বেড়ানো একটি নিরীহ সরীসৃপ—সান্ডা। হঠাৎ করেই এই প্রাণীটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কেন্দ্রবিন্দুতে। মিমের বন্যা থেকে শুরু করে তথ্যসমৃদ্ধ ভিডিও, এমনকি সান্ডার বাজার চাহিদা ও বন্যপ্রাণী শিকারের মতো উদ্বেগের আলোচনা—সবখানেই এখন এই ‘কাঁটা লেজযুক্ত টিকটিকি’র সরব উপস্থিতি। কিন্তু এমন কী ঘটলো যে, এই প্রাণীটি রাতারাতি আলোচনার শীর্ষে উঠে এলো?
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সামাজিক মাধ্যম এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে সান্ডা ভাইরালের পেছনে একাধিক কারণ বিদ্যমান।
প্রবাসীদের চোখে ‘ভিসা-টিকটিকি’:
সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে সান্ডা শিকার একটি অপ্রত্যাশিত আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, প্রবাসীরা মরুভূমির বালির উপর সান্ডা ধরার জন্য হন্যে হয়ে ছুটছেন। মজার ছলে কেউ বলছেন, “ভাই, এই সান্ডা না ধরতে পারলে চাকরি যাবে!”, আবার কারো মুখে শোনা যাচ্ছে, “কফিল বলেছে, সান্ডা না পেলে ভিসা ক্যানসেল!” আপাতদৃষ্টিতে এই ভিডিওগুলোতে কৌতুক মেশানো থাকলেও, এর গভীরে লুকিয়ে আছে প্রবাসী শ্রমিকদের কঠিন জীবন সংগ্রামের চিত্র।
এই ভিডিও এবং মিমগুলো যখন বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়, তখন তা দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। অনেকেই রসিকতা করে বলছেন, “বৈধ ভিসার চাবিকাঠি নাকি এখন একটি টিকটিকি!” ফলে সান্ডা একটি ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে, যা কেবল বিনোদন নয়, বরং প্রবাসীদের জীবনযাত্রার এক প্রতীকও বটে।
সান্ডার বিরিয়ানি: ফেসবুকের নতুন ট্রেন্ড:
ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করলেই এখন চোখে পড়ছে সান্ডার আলোচনা, ঠাট্টা আর রঙ্গ-তামাশা। গত কয়েকদিন ধরে এই সামাজিক মাধ্যমটির প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠেছে ‘সান্ডা’। দুই-তিন মিনিটের রিলে অন্তত ৪-৫টি সান্ডা বিষয়ক কনটেন্ট দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়টি নিয়ে চলছে দেদারসে হাসাহাসি এবং তৈরি হচ্ছে অসংখ্য মিম।
সান্ডা: মরুভূমির নিরীহ বাসিন্দা:
সান্ডা আসলে টিকটিকি প্রজাতির একটি সরীসৃপ, যার বৈজ্ঞানিক নাম Uromastyx। দেখতে অনেকটা গুইসাপের মতো হলেও এদের শরীর তুলনামূলকভাবে ছোট ও মোটা এবং এদের খাঁজযুক্ত লেজ আত্মরক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। ‘মাস্টিগুর’, ‘সান্ডা টিকটিকি’ বা ‘কাঁটা লেজযুক্ত টিকটিকি’ নামেও পরিচিত এই প্রাণীটি মূলত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি অঞ্চলে বসবাস করে। এরা তৃণভোজী এবং সাধারণত গাছপালা, ফুল ও বীজ খেয়ে জীবন ধারণ করে। তবে প্রয়োজনে পোকামাকড়ও এদের খাদ্য তালিকায় যুক্ত হয়।
‘সান্ডা তেল’: বাস্তবতা নাকি ভ্রান্তি?
সান্ডাকে ঘিরে প্রচলিত আরেকটি ধারণা হলো ‘সান্ডা তেল’। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এই তেলের ব্যবহারের কথা শোনা যায় এবং অনেকে এটিকে যৌন শক্তি বর্ধক হিসেবে প্রচার করে থাকেন। যদিও এর কার্যকারিতা বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত নয়, তবুও ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কিছু আঞ্চলিক হাটে এই তেল বিক্রি হতে দেখা যায়।
ধর্মের চোখে সান্ডা:
ইসলাম ধর্মানুসারে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নিজে কখনো সান্ডা খাননি, তবে এটি খেতে অন্য কাউকে নিষেধও করেননি। এই কারণে অনেক ইসলামিক পণ্ডিত এটিকে মাকরুহ (অপছন্দনীয়) হিসেবে বিবেচনা করেন। তবে হানাফি মাজহাবে এটিকে হারাম (নিষিদ্ধ) হিসেবে গণ্য করা হয়। অন্যান্য মাজহাবগুলোতে এই বিষয়ে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়।
বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া:
বাংলাদেশে এই ভাইরাল ট্রেন্ডটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। কেউ এটিকে নিছক মজার ঘটনা হিসেবে দেখছেন, আবার অনেকে এটিকে অশোভন এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের সম্মানহানিকর বলে মনে করছেন। তবে অনেকেই বলছেন, এই ভিডিওগুলো আসলে প্রবাসীদের কঠিন জীবনের প্রতিচ্ছবি, যা তারা মিমের মাধ্যমে প্রকাশ করছেন।
ভাইরাল হওয়ার রহস্য:
বিশেষজ্ঞদের মতে, সোশ্যাল মিডিয়ার অ্যালগরিদম অনেক সময় অপ্রত্যাশিত বিষয়কেও ভাইরাল করে তুলতে পারে, যদি তাতে কোনো চমকপ্রদ বা বিতর্কিত উপাদান থাকে। সান্ডাকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন গল্প—যেমন এর ‘শক্তি বর্ধক’ ক্ষমতা অথবা আন্তর্জাতিক বাজারে এর আকাশছোঁয়া চাহিদা—এই ধরনের দাবিগুলোই মূলত মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
সবমিলিয়ে, মরুভূমির এক নিরীহ প্রাণী সান্ডা এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এক আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।