বুধবার ২৩ জুলাই, ২০২৫

শহীদ শিক্ষিকা মাহরিন সুলতানা: অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে

শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী/ছবি: সংগৃহীত

শিক্ষক শব্দটি উচ্চারণ করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজন আলোকবর্তিকার চিত্র, যিনি জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলেন ভবিষ্যতের নেতৃত্বে। কিন্তু কিছু শিক্ষক তাঁদের দায়িত্বকে শুধু পেশাগত সীমায় আটকে না রেখে, তা রূপ দেন নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও আত্মোৎসর্গে। তেমনই একজন ব্যতিক্রমী ও সাহসী শিক্ষিকার নাম মাহরিন সুলতানা।

২০২৫ সালের ২১ জুলাই দুপুরে রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এক ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে শহীদ হন এই মানবিক শিক্ষিকা। তাঁর আত্মত্যাগ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে; নড়ে ওঠে মানুষের বিবেক।

মাহরিন সুলতানার মৃত্যু আমাদের কাঁদিয়েছে, কিন্তু তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা আমাদের গর্বিতও করেছে। এই ভয়াবহ ঘটনার মধ্যে থেকেও তিনি যে দৃঢ়তা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন, তা অমর হয়ে থাকবে শিক্ষাঙ্গনের ইতিহাসে। একজন শিক্ষক কীভাবে নিজের ছাত্র-ছাত্রীর জন্য জীবন দিতে পারেন, মাহরিন সুলতানা তারই এক অমলিন দৃষ্টান্ত। এই লেখার মাধ্যমে আমরা স্মরণ করতে চাই সেই মহান আত্মাকে, যিনি নিজের জীবনের বিনিময়ে অন্যদের প্রাণ রক্ষা করেছেন। যাঁর ত্যাগ বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে।

২১ জুলাই ২০২৫। এই তারিখটি বাংলাদেশের শিক্ষা ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। কারণ, সেদিন আমরা হারিয়েছি এক অনন্য সাহসী নারী, একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষিকা কে, যিনি শুধু পাঠদানেই নয়, নিজের জীবন উৎসর্গ করে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করে শিক্ষকতা পেশাকে নিয়ে গেছেন শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ স্তরে। তিনি হলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মাহরিন সুলতানা। এই দিনটি এখন শুধু একটি তারিখ নয়, এটি এক আত্মত্যাগের প্রতীক, এক অনুপ্রেরণার নাম।

প্রতিদিনের ন্যায় ঐদিন ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজের ক্লাস চলছিল দুপুর ঠিক স্কুল ছুটি হওয়ার সময়ে একটি প্রশিক্ষণ বিমান আগুন লেগে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে ওই স্কুল এন্ড কলেজের ছাদের উপর। সে সময় স্কুল ছুটির অপেক্ষায় অপেক্ষা করছিল কিছু ছাত্র ছাত্রী অভিভাবক বৃন্দ। ঠিক কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিমানটি আগুন লেগে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে স্কুলটির ছাদের উপর মুহূর্তের মধ্যেই লেগে যায় আগুন।

স্কুল ছুটির আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে রূপ নেয়, যখন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বিমানটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। দ্রুত নিচে নামতে থাকা বিমানে এক ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়। শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, অভিভাবকরাও দিশেহারা।

ঠিক সেই সময়ে দৃপ্ত পায়ে উঠে দাঁড়ান মাহরিন সুলতানা। ভয়কে জয় করে তিনি আশ্বস্ত করতে থাকেন চারপাশের ছাত্রছাত্রীদের। ছোট ছোট শিশুদের বুকে জড়িয়ে নেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “ভয় পেও না, আমি আছি। কিন্তু তিনি শুধু কথার আশ্বাস দেননি, দিয়েছেন নিজের জীবন। শিক্ষিকা মাহারীর সুলতানা সে সময় ইচ্ছা করলে তিনি নিজে বাঁচতে পারতেন তার শরীর

আগুন লাগছিল আগুন লাগা অবস্থাও তিনি তার প্রাণপ্রিয় ছাত্র ছাত্রীদেরকে টেনে বের করছিলেন, সে সময় তার শরীরে আগুনে ৮০% পুড়ে যায়। চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় তাকে হাসপাতালে সেখানে তিনি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে যান।

Rising Cumilla - Osman Ghani
লেখক/গ্রাফিক্স: রাইজিং কুমিল্লা

এই আত্মত্যাগ শুধু ব্যক্তিগত সাহসিকতার দৃষ্টান্ত নয়, এটি এক জাতীয় গৌরব। একজন নারী, একজন শিক্ষক কীভাবে শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবন দিয়ে অনন্ত কালের জন্য বেঁচে থাকতে পারেন, তা মাহরিন সুলতানা দেখিয়ে গেলেন। আজ তাঁর মৃত্যুতে কাঁদছে দেশ, কিন্তু তাঁর বীরত্বে জেগে উঠছে জাতি।

মাহরিন সুলতানার এই আত্মত্যাগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিক্ষকতা কেবল একটি পেশা নয়, এটি একটি সাধনা। যেখানে আত্মনিবেদনই প্রধান। আমাদের সমাজে বহু শিক্ষিকা রয়েছেন যারা নীরবে কাজ করে যান, আলোচনার বাইরে থেকে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলেন। মাহরিন সুলতানা সেই নিঃশব্দ সংগ্রামীদের একজন, যিনি প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়েও ছাত্রদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দেন।

এই আত্মত্যাগ আমাদের জাতীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতা পুনরুদ্ধারের এক বিরল বার্তা দেয়। যখন চারদিকে লোভ, হিংসা, স্বার্থপরতা এবং আত্মরক্ষার প্রতিযোগিতা চলছে, তখন মাহরিন সুলতানার মতো একজন শিক্ষিকার এই আত্মদান আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মানবতা এখনো বেঁচে আছে। সাহস এখনো আছে, মা-মাটি-মনের মানুষ এখনো জন্ম নেন।

এই ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা অভূতপূর্ব। সবাই একবাক্যে বলছে, মাহরিন সুলতানার এই আত্মত্যাগ রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। একজন শিক্ষিকা যিনি কর্তব্য পালনের চূড়ান্ত সীমায় গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁকে “শিক্ষক শহীদ” ঘোষণা করা হোক এমন দাবিও উঠেছে।

অনেকে চাইছেন, তাঁর নামে একটি শিক্ষাবৃত্তি চালু করা হোক, তাঁর কাহিনি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক, যাতে নতুন প্রজন্ম জানে, একজন শিক্ষক শুধু জ্ঞান দেন না, প্রয়োজনে জীবন দেন।

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষের উচিত, বিদ্যালয় চত্বরে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা যেখানে লেখা থাকবে, “তিনি প্রাণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাঁচিয়েছেন, তিনি শুধু শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন ভালোবাসার আরেক নাম।”

এই লেখার মাধ্যমে আমি শুধু একজন শহীদ শিক্ষিকাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই না, বরং একটি প্রশ্ন তুলতে চাই, আমরা কি সত্যিই এমন আত্মত্যাগের মূল্যায়ন করতে জানি? মাহরিন সুলতানার স্মৃতিকে আমরা শুধু কিছুদিন আবেগ দিয়ে স্মরণ করব, নাকি তাঁর আদর্শকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় স্থায়ী করে গড়বো?

আমরা কি তাঁর নামে রাষ্ট্রীয় সম্মান ঘোষণা করবো? তাঁর আত্মত্যাগকে জাতীয় ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখবো? না কি সবকিছু এক মাসের আবেগে চাপা পড়ে যাবে?

রাষ্ট্র, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে জোর দাবি, মাহরিন সুলতানার মতো আত্মত্যাগী শিক্ষকের যথার্থ মূল্যায়ন হোক। তাঁর নামে শিক্ষাপদক, বৃত্তি ও শিক্ষক প্রশিক্ষণে বিশেষ অধ্যায় সংযোজন করা হোক। তাঁর সাহসিকতা শুধু স্মৃতিচারণের জন্য নয়, তা হোক শিক্ষকদের উৎসাহ ও আদর্শের উৎস।

এখন সময় মাহরিন সুলতানাদের আত্মত্যাগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার। সময় এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে “দুর্যোগকালীন প্রস্তুতি”, “মানবিক আচরণ”, এবং “নেতৃত্ব বিকাশ”-এর প্রশিক্ষণ চালুর। যেন ভবিষ্যতে এমন বিপদে আরও অনেক শিক্ষক, আরও অনেক মাহরিন তৈরি হন, যারা শুধু নিজের জন্য নয়—অন্যের জন্য বাঁচেন ও লড়েন।

শহীদ শিক্ষিকা মাহরিন সুলতানার দেহ হয়তো আজ মাটির নিচে, কিন্তু তাঁর আত্মা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় চিরকাল জীবিত থাকবে। তিনি ইতিহাস হয়ে থাকবেন, অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবেন, ভালোবাসার এক অনন্ত প্রতীক হয়ে থাকবেন।
তাঁর কাহিনি আমাদের শেখাবে, সত্যিকারের শিক্ষক হওয়া মানে কেবল বই পড়ানো নয় মানুষ গড়া, ভালোবাসা বিলানো, আর প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়েও শিক্ষার্থীদের বাঁচানো।

শহীদ শিক্ষিকা মাহরিন সুলতানার আত্মত্যাগ শুধু একটি ট্র্যাজেডি নয়, এটি এক উজ্জ্বল শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত। এক মমতাময়ী শিক্ষক নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের রক্ষায়। এই আত্মোৎসর্গ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শিক্ষকতা শুধুমাত্র একটি পেশা নয়,এটি একটি সাধনা, এটি আত্মদান ও ভালোবাসার চরম নিদর্শন। মাহরিন সুলতানা যে সাহস ও মানবিকতা দেখিয়েছেন, তা যুগে যুগে দেশের সব শিক্ষক, অভিভাবক ও নাগরিকের হৃদয়ে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এই অপূরণীয় ক্ষতি কেবল তাঁর পরিবার, সহকর্মী বা শিক্ষার্থীদের নয়, পুরো জাতির। এমন আত্মত্যাগের মূল্য দিতে না পারলে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজ এবং রাষ্ট্র এক ভয়াবহ মানবিক দুর্যোগের দিকে ধাবিত হবে। তাই মাহরিন সুলতানার প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে হলে, আমাদের প্রয়োজন মানবিকতা, দায়িত্ববোধ ও নিরাপদ শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি অঙ্গীকার। তাঁর আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়, তাঁর আদর্শ যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখায়, সে চেষ্টাই হোক আমাদের সবার নৈতিক দায় ও কর্তব্য।

শহীদ মাহরিন সুলতানা নেই, কিন্তু তাঁর কর্ম, আদর্শ ও ভালোবাসা চিরকাল বেঁচে থাকবে আমাদের হৃদয়ে। তিনি হয়ে উঠবেন সাহস, মানবিকতা ও শিক্ষকের মর্যাদার এক অনন্ত প্রতীক।

ওসমান গনি

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আরও পড়ুন