মে ৫, ২০২৫

সোমবার ৫ মে, ২০২৫

মুছাপুর ক্লোজার পুনর্নির্মাণ: কৃষি ও উপকূলীয় সুরক্ষায় নতুন প্রত্যাশা

মুছাপুর ক্লোজার পুনর্নির্মাণ: কৃষি ও উপকূলীয় সুরক্ষায় নতুন প্রত্যাশা
মুছাপুর ক্লোজার পুনর্নির্মাণ: কৃষি ও উপকূলীয় সুরক্ষায় নতুন প্রত্যাশা/ছবি: প্রতিনিধি

মুছাপুর ক্লোজার নোয়াখালী জেলার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নে ছোট ফেনী নদীর মোহনায় নির্মিত একটি গুরুত্বপূর্ণ জল নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প।

কৃষি জমির লবণাক্ততা রোধ, মিঠা পানির সংরক্ষণ এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে এই ক্লোজার নির্মাণ করা হয়েছিল।

এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৪-০৫ অর্থবছরে এবং সম্পন্ন হয় ২০১৬ সালে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তত্ত্বাবধানে।

ক্লোজারটি ১.০৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এর সাথে একটি ২৩ ভেন্টের রেগুলেটর সংযুক্ত আছে, যার মাধ্যমে নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

এটি নোয়াখালী, কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলার মোট ১৪টি উপজেলার প্রায় ১.৩০ লাখ হেক্টর কৃষিজমিকে লবণাক্ততা থেকে রক্ষা করে।

ক্লোজারটির মাধ্যমে মিঠা পানি সংরক্ষণ সহজ হয়, যা খরার মৌসুমে কৃষির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এর ফলে কৃষি উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শস্য নিবিড়তা ১৫৫.৬৬ শতাংশ থেকে ২২০.৪৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, নদীর তীব্র স্রোত এবং বিশেষ করে অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে ক্লোজারের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।

মাটি সরে যাওয়া, কাঠামোগত ক্ষয় এবং পানি চাপের কারণে ২০২৪ সালের ২৬ আগস্ট মুছাপুর ক্লোজারের একটি বড় অংশ ভেঙে পড়ে।

এর ফলে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরএলাহী, চরকাঁকড়া, চরহাজারী ইউনিয়ন এবং পাশের ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ, চরচান্দিয়া ও নবাবপুর ইউনিয়ন ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়।

হাজার হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারায় এবং কৃষিজমি পানির নিচে তলিয়ে যায়। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি, মাছের ঘের ভেসে যাওয়া এবং মানুষের জীবন-জীবিকায় মারাত্মক প্রভাব পড়ে।

ক্লোজার ধসে পড়ার পর সরকার জরুরি ভিত্তিতে ক্ষয়ক্ষতির নিরূপণ এবং দ্রুত পুনর্নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মুছাপুর রেগুলেটর পুনঃনির্মাণ এবং বামনী নদীতে নতুন ক্লোজার নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করেছে।

প্রকল্পের আওতায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরও টেকসই, মজবুত এবং দীর্ঘস্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

নতুন ক্লোজারে নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ বিবেচনা করে পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উন্নত করা হবে, যাতে ভবিষ্যতে ভাঙন ও বন্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।

মুছাপুর ক্লোজার শুধু একটি জল নিয়ন্ত্রণ কাঠামো নয়; এটি এলাকাবাসীর জীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িত।

কৃষি উৎপাদন ছাড়াও এটি পরিবেশ রক্ষায়, মিঠা পানির সংরক্ষণে এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

একই সঙ্গে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত। স্থানীয়রা একে “মিনি কক্সবাজার” নামে ডাকেন।

ক্লোজারের পাশে বিস্তীর্ণ সৈকত অঞ্চল, সবুজ চর এবং নদী মোহনার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক এখানে ভিড় করেন।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে হাজার হাজার পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।

বর্তমানে মুছাপুর ক্লোজারের পুনঃনির্মাণ শুধু কৃষি ও পরিবেশ রক্ষার জন্য নয়, বরং উপকূলীয় অঞ্চলের সার্বিক টেকসই উন্নয়ন, জনজীবনের নিরাপত্তা এবং পর্যটন বিকাশের জন্য অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও এ প্রকল্পের দ্রুত বাস্তবায়ন এবং সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছে।

সঠিক পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুছাপুর ক্লোজার আবারও তার পুরোনো গৌরব ফিরে পাবে এবং উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জন্য একটি স্থায়ী আশ্রয় হবে।

আরও পড়ুন