
তিরুবনন্তপুরম, কেরালা: দক্ষিণ ভারতের রাজ্য কেরালায় ‘মগজ-খেকো’ অ্যামিবার সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এই পরজীবী মানুষের মস্তিষ্কে ভয়াবহ সংক্রমণ ঘটাচ্ছে, যার নাম প্রাইমারি অ্যামিবিক মেনিংগোএনসেফালাইটিস (পিএএম)। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৬১ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবং এদের মধ্যে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার বেশিরভাগই ঘটেছে গত কয়েক সপ্তাহে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য জুড়ে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
কেরালার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বীণা জর্জ এই পরিস্থিতিকে এক গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকট বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, আগে এই সংক্রমণ কোঝিকোড ও মালাপ্পুরম জেলার কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও, এখন রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্তদের মধ্যে তিন মাসের শিশু থেকে শুরু করে ৯১ বছরের বৃদ্ধও রয়েছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও বলেন, “গত বছর আমরা একটি একক পানির উৎস থেকে সংক্রমণের ঘটনা পেয়েছিলাম, কিন্তু এবার বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন উৎস থেকে সংক্রমণ হচ্ছে। এতে আমাদের অনুসন্ধান কাজ আরও জটিল হয়ে পড়েছে।”
পিএএম কী এবং কীভাবে ছড়ায়?
কেরালা সরকারের একটি নথি অনুযায়ী, পিএএম হলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের একটি মারাত্মক রোগ। এই রোগ মস্তিষ্কের টিস্যু ধ্বংস করে এবং মস্তিষ্কে মারাত্মক ফোলা সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কারণ হয়। সাধারণত সুস্থ শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং তরুণদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়।
নথিতে বলা হয়েছে, গরম ও স্থির পানিই এই ‘মগজ-খেকো’ অ্যামিবার প্রধান বাহক। সংক্রমণ প্রধানত নাকের মাধ্যমে ঘটে। দূষিত পানি পান করলে এই রোগ হয় না, বরং যারা এমন পানিতে সাঁতার কাটে, ডুব দেয় বা গোসল করে, তারাই বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
নথিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব উষ্ণায়ন এই রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ বিনোদনের জন্য বেশি সময় পানিতে কাটাচ্ছে, যা এই অণুজীবের সংস্পর্শ বাড়াচ্ছে। তবে এটি ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়ায় না।
পিএএম সংক্রমণের লক্ষণ ও চিকিৎসা
এই রোগের মৃত্যুহার অত্যন্ত বেশি, কারণ সময় মতো রোগটি শনাক্ত করা কঠিন। প্রাথমিক লক্ষণগুলো ব্যাকটেরিয়াজনিত মেনিনজাইটিসের মতোই, যেমন— তীব্র মাথাব্যথা, জ্বর, বমি বমি ভাব ও বমি।
নথিতে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ রোগী যখন চিকিৎসা নিতে আসেন, তখন তাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে সংক্রমণের লক্ষণ দেখা যায়। সাধারণত, উষ্ণ মাসগুলোতে যারা স্থির ও সাধু পানিতে সাঁতার কাটা, ডাইভিং বা গোসলের অভ্যাস রাখেন, তাদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যায়। সংক্রমণের ১ থেকে ৯ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয় এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা মারাত্মক আকার ধারণ করে। মস্তিষ্কে প্রবেশের পর নিগ্লেরিয়া ফাউলেরি খুব দ্রুত প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দেয়, ফলে কয়েক দিনের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বীণা জর্জ জোর দিয়ে বলেছেন যে, প্রাথমিক শনাক্তকরণই এই রোগ থেকে বাঁচার প্রধান উপায়। তিনি বলেন, গত ছয় দশকে যারা পিএএম থেকে বেঁচে গেছেন, তাদের প্রায় সবার ক্ষেত্রেই রোগটি প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। দ্রুত শনাক্তকরণ এবং অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধের সমন্বিত প্রয়োগ জীবন বাঁচাতে পারে।
রোগটি বিরল হওয়ায় এবং দ্রুত মৃত্যুর কারণে কার্যকর ওষুধের পরীক্ষা কঠিন হয়ে উঠেছে। তবে, তত্ত্বগতভাবে, একটি অ্যামিবিসাইডাল ড্রাগ বা কয়েকটি ওষুধের মিশ্রণ ব্যবহার করা যেতে পারে যা রক্ত-মস্তিষ্কের বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম।
কেরালা সরকার জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যে, যদি জমে থাকা পানির সংস্পর্শে আসার পর পিএএম সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দেয়, তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে কেরালায় প্রথম পিএএম শনাক্ত হয়। ২০২৩ সাল পর্যন্ত মাত্র আট জনের সংক্রমণ ধরা পড়ে। তবে গত বছর এই সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে ৩৬ জনে পৌঁছায়, যার মধ্যে ৯ জনের মৃত্যু হয়। আর চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসেই ৬১ জন আক্রান্ত এবং ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা আগের বছরের প্রায় দ্বিগুণ।
সূত্র: এনডিটিভি