মে ২৫, ২০২৫

রবিবার ২৫ মে, ২০২৫

ভারতীয় অনুপ্রবেশ নাকি উন্নয়ন: চারুকলা ভবন ঘিরে শিক্ষার্থীদের ভাবনা

ভারতীয় অনুপ্রবেশ নাকি উন্নয়ন: চারুকলা ভবন ঘিরে শিক্ষার্থীদের ভাবনা
ভারতীয় অনুপ্রবেশ নাকি উন্নয়ন: চারুকলা ভবন ঘিরে শিক্ষার্থীদের ভাবনা/ছবি: প্রতিনিধি

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, যার পুরো হৃদয়জুড়ে রয়েছে প্রাণ-প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের অদ্ভুত ও চমৎকার এক সহাবস্থান। এই ক্যাম্পাস শুধু একটি শিক্ষাঙ্গণ নয়, বরং দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কেন্দ্র।

এখানে প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দুর্লভ ও বিপন্ন প্রজাতির সব দেশি-বিদেশি পরিযায়ী পাখি আসে, আবাস খুঁজে পায়, আর “মেইন বার্ডস লেক” শুধু একটি জলাধার নয়, এটি ক্যাম্পাসের প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত ঐতিহ্যেরও প্রতীক।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ, উৎকণ্ঠা ও ক্ষোভের সাথে জানাতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরই ছত্রছায়ায় এবং ভারতীয় অর্থায়নের আড়ালে একটি বিধ্বংসী প্রকল্প “চারুকলা ভবন নির্মাণ প্রকল্প” এই লেকের প্রাণকেন্দ্রেই গড়ে তোলার পাঁয়তারা চলছে।

পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (EIA) ছাড়াই, সুদূরপ্রসারী মাস্টারপ্ল্যান ব্যতিরেকে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল অংশীজনদের সাথে কোনোরকম পরামর্শ না করেই এই ধরনের প্রকল্প চালানো হচ্ছে।

এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজের কারণে ইতোমধ্যে প্রায় দুই শতাধিকেরও বেশি বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে, যার আর্থিক বাজার মূল্য প্রায় কয়েক কোটি টাকা হলেও প্রকৃতপক্ষে এর ক্ষতি পরিবেশগত ভারসাম্য হারানোর মাধ্যমে অপূরণীয়।

দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় পরিযায়ী সব পাখিদের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দিন দিন, যা আন্তর্জাতিকভাবে পরিবেশগত অপরাধ (Environmental Crime)। এই প্রকল্প বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক পরিবেশবান্ধব ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে।

একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়াই একটি বিভাগকে “ফ্যাকাল্টি” হিসেবে দেখিয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে, যা প্রতারণামূলক ও দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রকল্প পরিচালক স্বয়ং সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষক, এটি স্বার্থ-সংঘর্ষের মারাত্মক উদাহরণ।

প্রকল্পের ব্যয়ের হিসেব দ্বিগুণ-তিনগুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, যা জনগণের কষ্টার্জিত অর্থের চরম অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ও লুটপাটের অন্যতম উদাহরণ।

প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সন্ত্রাসী সংগঠন ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সহায়তায় সন্ত্রাসী কায়দায় গাছ কাটা ও কাজ শুরুর নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছিল তৎকালীন সময়ে।

এটি নিঃসন্দেহে মনে করিয়ে দেয়, এ ধরনের নির্মাণ প্রকল্প আওয়ামী লীগের আমলে প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাকেন্দ্রিক স্বৈরাচারী উন্নয়ন মডেলের অন্যতম প্রতিচ্ছবি।

এই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে প্রকৃতি ধ্বংস, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের নোংরা চক্রান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবিসমূহ:

১ – চারুকলা ভবন নির্মাণের জন্য নির্ধারিত বর্তমান স্থান (মেইন বার্ডস লেক সংলগ্ন এলাকা) অবিলম্বে উন্মুক্ত করে প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে।

২ – এই প্রকল্প বাতিল করে, পরিবেশবান্ধব ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পুনরায় উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে যাতে প্রকৃতি, অংশীজন, এবং একাডেমিক স্বার্থ সুরক্ষিত ও নিশ্চিত হয়।

৩ – প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে ডিপিপি জালিয়াতি, হিসাব জাল, অর্থ আত্মসাৎ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে তদন্ত করে তাকে অপসারণ ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

৪ – একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়াই “ফ্যাকাল্টি” হিসেবে ভবনের অনুমোদন নেওয়ার প্রতারণার দায়ে প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৫ – ভারতীয় অর্থায়নের আড়ালে বাস্তবায়িত কোনো প্রকল্প, যা পরিবেশ বিনষ্টকারী তা জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে বাস্তবায়ন করা যাবে না এই মর্মে লিখিত ও নীতিগত ঘোষণা উপাচার্যকে দিতে হবে।

৬ – ১৭ মার্চ সিন্ডিকেট সভায় ভবনের স্থান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত পুনরায় বাতিল করে পূর্ব সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে হবে এবং ১২ মে এর সংশোধিত বিজ্ঞপ্তিকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে।

৭ – এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে যেসব স্টেকহোল্ডারদের মতামত উপেক্ষা করে কাজ করা হয়েছে, তাদের অংশগ্রহণে একটি স্বচ্ছ ও জনসমক্ষে উন্মুক্ত আলোচনা সভা আয়োজন করতে হবে।

পরিশেষে শিক্ষার্থীরা বলেন, “জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক সমাজ ও প্রশাসনের সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ কোনো দলীয় সরকার বা বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকৃতি বিনাশী ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রকল্পের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা ভারতের আধিপত্যবাদের এক নয়া রূপ, যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা আশাবাদী, প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও পরিবেশগত নৈতিকতা রক্ষা করবেন। অন্যথায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আপনাদের এই আত্মসমর্পণকে “পরিবেশ বিনাশী আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত” হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত করবে।”

আরও পড়ুন