
তাবলীগের চলমান সংকটের সমাধান খুঁজতে হলে এর মূলনীতি ও আদর্শের দিকেই ফিরে যেতে হবে। বাইরে থেকে চাপানো কোনো সমাধান কাজে আসবে না। উভয়পক্ষের অনুসারীরা যদি কয়েকটি বিষয়ের ওপর মনোযোগ দেন, তাহলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। যারা তাবলীগের মূলনীতি লঙ্ঘন করছেন, তারা যদি নিজেদের ভুল শুধরে নেন, তাহলেই এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
প্রথমত, তাবলীগ জামাত ‘ইলম’ নম্বরে স্পষ্টভাবে বলেছে, “আমরা ফাযায়েলে আমল তা’লীমের হালকায় শিখব। আর মাসায়েলে ইলম উলামায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করে শিখব।” এখানে সবসময়ই জোর দেওয়া হয়েছে যে, ‘আমরা প্রতিটি কাজ উলামায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করে করব এবং তাদের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাপন করব।’ যারা এখন উলামায়ে কেরামকে জিজ্ঞাসা করে চলেন না, কিংবা জিজ্ঞাস করার প্রয়োজন মনে করেন না, অথবা উলামায়ে কেরাম কোনো পরামর্শ দিলে তা গ্রহণ করেন না; তারাই বর্তমান সংকটের প্রধান কারণ। তারা যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের নিজস্ব নীতি ও দাওয়াতে ফিরে না আসবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, তাবলীগের অনুসারীরা সবসময় বলে এসেছেন, ‘দীনের বড় হলেন উলামায়ে কেরাম। তাদের সাথে সাক্ষাৎ করাকে এবাদত মনে করবে। তাদেরকে তাজিম ও সম্মান করা দ্বীনের অংশ। তাদের কাছে সাক্ষাতে গেলে নিজ থেকে মোসাফাহার জন্য হাত বাড়াবে না, যতক্ষণ না তিনি হাত বাড়ান। তিনি জিজ্ঞেস করলে কথা বলবে। তাদেরকে দ্বীনের দাওয়াত দিবে না। বরং জিজ্ঞেস করলে নিজেদের কাজের কিছু কারগুজারি ও হালাত শুনিয়ে দিবে। এর বেশি নয়।’ এখন যারা এই আহ্বান থেকে সরে এসেছেন, বরং ওলামায়ে কেরামকে সম্মান জানানোর পরিবর্তে অপমানিত করছেন, অথবা তাদের কথা শোনার পরিবর্তে তাদেরকে কথা শোনাতে ব্যস্ত, তারা নিজেদের মূল দাওয়াতে ফিরে যাওয়া ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, দাওয়াতের সাথীরা পরামর্শের সময় বলেন, ‘দুনিয়াবী কাজে পরামর্শ করা মুস্তাহাব আর দ্বীনি ইজতেমায়ী কাজে পরামর্শ করা ওয়াজিব।’ তারা আরও বলেন, ‘পরামর্শের আগে পরামর্শ নেই, পরামর্শের পরে সমালোচনা নেই। পরামর্শের আগে পরামর্শ করা ষড়যন্ত্র। আর পরে সমালোচনা করা বিদ্রোহ!’ তাবলীগের কাজ নিঃসন্দেহে একটি দ্বীনি কাজ। সুতরাং এর যাবতীয় ইজতেমায়ী কাজগুলো অবশ্যই দায়িত্বশীলদের যথাযথ পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পাদিত হতে হবে। যেখানে একটি ১৩-১৪ জনের চলতি জামাতের আমির পরস্পর পরামর্শ ও মুরুব্বীদের সিদ্ধান্তক্রমে ঠিক করা হয়, নিজের আমিরত্ব দাবি করার সুযোগ নেই, সেখানে কোটি কোটি মানুষের জামাতের আমীর কিভাবে যথাযথ পরামর্শ ছাড়া নির্ধারিত হতে পারে? অবশ্যই সেটা কারও নিজের দাবিতে, অথবা কিছু পুতুল অনুসারীর রায়ে নির্ধারিত হতে পারে না।
চতুর্থত, তাবলীগের কাজে একথা বলা হয়: ‘মসজিদ পরিষ্কার বা বাথরুম পরিষ্কার এ ধরনের কাজ ছাড়া নিজের নাম কোনো কাজে পেশ করবে না। বরং এগুলো ছাড়া অন্য সবকাজে অন্য ভাইদের নাম প্রস্তাব করবে।’ এমন একটি বৃহৎ জামাতের নেতৃত্ব নিশ্চয়ই বাথরুম বা মসজিদ পরিষ্কার করার মতো নয় যে, নিজেকে এর জন্য পেশ করবে। সুতরাং এখানে প্রত্যেকে নিজের চাইতে অন্যকে উপযুক্ত মনে করবে। যদি কেউ নিজ থেকে এই পদ দখলের কৌশল অবলম্বন করে, অথবা এমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিজেকেই পেশ করে এবং নিজেকে ছাড়া অন্যকে অযোগ্য মনে করে, সে ব্যক্তি অবশ্যই দাওয়াতের মূলনীতি লঙ্ঘন করেছে। তাকে দাওয়াতের মূলনীতিতে ফিরে আসতে হবে।
পঞ্চমত, তাবলীগ জামাত একটি মসজিদভিত্তিক দাওয়াতি কর্মধারা। তারা মসজিদ থেকে দ্বীনি দাওয়াতের কার্যক্রম পরিচালনা করে। মানুষজনকে মসজিদের দিকে আহ্বান করে এবং মসজিদভিত্তিক জীবনযাপনে উৎসাহিত করে। সুতরাং মসজিদকে নিরাপদ রাখা এবং এতে যেন ঝগড়াঝাটি ও হাঙ্গামা সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা জরুরি। মানুষজনকে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়া যেমন শরীয়তের মাসআলা পরিপন্থী, তেমনি তা তাবলীগের নিয়ম পরিপন্থী। সুতরাং যে বা যারা এই মূলনীতি থেকে সরে এসেছেন, তাদেরকে মূলনীতিতে ফিরে যেতে হবে। আগে যা হবার হয়েছে, এখন থেকে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়ার রীতি বন্ধ করতে হবে।
ষষ্ঠত, ইকরামুল মুসলিমীন তাবলীগ জামাতের অন্যতম নিদর্শন ও মিশন। নিজেদের মধ্যে এবং অপরের ক্ষেত্রে একরাম, সেবা ও সম্মানের যে অনন্য দৃষ্টান্ত তাবলীগ স্থাপন করেছে, তা এক বিস্ময়কর কারামত। ইকরামের যে ব্যাপক চর্চা এই জামাত করে দেখিয়েছে, তা অন্য কোনো জামাত স্থাপন করতে পারেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তাবলীগ জামাত অন্যদের বেলায় ইকরাম এখনও ঠিক রাখলেও বিবাদমান দুই পক্ষ একে অপরের প্রতি তা ধরে রাখতে পারেনি। যে কারণে সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। সুতরাং তাবলীগের সাথীদেরকে নিজেদের মিশন ও নিদর্শনের দিকে ফিরে যেতে হবে। ইকরামুল মুসলিমীনের ঝাণ্ডা পুনরায় তুলে ধরতে হবে। ঠিক কোরআন মাজীদের এই আয়াতের মতো: ‘কাফিরদের বেলায় অত্যন্ত কঠোর এবং নিজেরা পরস্পর অত্যন্ত দয়াপরবশ।’
মৌলিকভাবে এই কয়েকটি জিনিস তাবলীগের সাথীরা ঠিক করে নিলে চলমান সংকট ইনশাআল্লাহ সমাধান হয়ে যাবে। যারা যে পরিমাণে ত্রুটি করেছেন, তার সেই পরিমাণ সংশোধন জরুরি! আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বোঝার তৌফিক দান করুন, আমীন।