
গবেষণায় প্রথমবারের মতো দৃশ্যমান হলো নারী ও পুরুষদের অবৈতনিক এবং অদৃশ্য শ্রম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর প্রকাশিত হাউসহোল্ড প্রোডাকশন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্টের (এইচপিএসএ) তথ্য অনুযায়ী, জিডিপিতে গৃহকর্মের অবৈতনিক কাজের অবদান ৬ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, বিনা বেতনে, অদেখা নয়: বাংলাদেশ নারীদের বিনা বেতনে সেবা এবং গৃহস্থালির কাজ স্বীকৃতি দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইউএন উইমেন বাংলাদেশ, বিশ্বব্যাপী উইমেন কাউন্ট প্রোগ্রামের সহায়তায় এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এর প্রোডাকশন সেলেলাইট অ্যাকাউন্ট (এইচপিএসএ) এর কারিগরি সহায়তায়। বাংলাদেশে অবৈতনিক গৃহস্থালি এবং যত্নের কাজের এই অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিনা বেতনে গৃহস্থালি এবং যত্নের কাজ – যেমন রান্না করা, লন্ড্রি পরিষ্কার করা, গৃহস্থালি ব্যবস্থাপনা এবং শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যগত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য সেবা করা অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নারীরা বেশিরভাগ কাজই সম্পাদন করেন, যা অপরিহার্য কিন্তু প্রচলিত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান থেকে বাদ দেওয়া হয়।
আরও জানানো হয়, বিবিএস সময় ব্যবহার জরিপ ২০২১ এবং শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ এর উপর ভিত্তি করে, এইচপিএসএ অনুমান করে যে ২০২১ সালে অবৈতনিক গৃহস্থালি এবং যত্নের কাজের অবদান ৬ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন টাকা, যা জিডিপির ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। অবৈতনিক কাজের যে অবদান এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ ছিল নারীদের অবদান।
অনুষ্ঠানে ইউএন উইমেন বাংলাদেশের প্রোগ্রাম বিশ্লেষক মিসেস নুবায়রা জেহিন একটি কেয়ার ক্যালকুলেটর ব্যবহার করে প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপট নির্ধারণ করেন। যেটি একটি টুল যা ব্যক্তিদের প্রতিদিন অবৈতনিক গৃহস্থালি এবং যত্নের কাজে ব্যয় করা সময় পরিমাপ করতে সাহায্য করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুর্শিদ। তিনি বলেন, “নারীর শ্রম দীর্ঘদিন ধরে অর্থনীতির ছায়ায় ছিল। আজকের এই প্রতিবেদন সেই অমূল্য অবদানকে দৃশ্যমান করল।”
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মমতাজ আহমেদ এনডিসি, সিনিয়র সচিব, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং আলেয়া আক্তার, সচিব, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান। এছাড়াও অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএন উইমেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি গীতাঞ্জলি সিংহ। অনুষ্ঠানটি সভাপতিত্ব করেন বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
বিবিএসের উপপরিচালক আসমা আখতার প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, সময় ব্যবহার জরিপ ২০২১ এবং শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ এর তথ্য বিশ্লেষণ করে এই হিসাবটি তৈরি করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে ইউএন উইমেনের নুবাইরা জেহেন একটি বিশেষ সরঞ্জাম ‘কেয়ার ক্যালকুলেটর’ ব্যবহার করে দেখান, একজন মানুষ প্রতিদিন কতটা সময় অবৈতনিক কাজে ব্যয় করেন।
প্রতিবেদনে অবৈতনিক কাজকে অর্থনীতির মূল স্রোতে আনতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- যত্ন খাতকে জাতীয় বাজেট ও উন্নয়ন কৌশলে অগ্রাধিকার দেওয়া।
- আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ে নীতি প্রণয়ন করা।
- বেসরকারি খাতে পরিবার-বান্ধব নীতি গ্রহণ ও যত্ন-ভিত্তিক চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি।
- পুরুষ ও ছেলেদের পারিবারিক যত্ন কাজে উৎসাহিত করা।
- এবং নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ নিশ্চিত করা।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান পরিসংখ্যানবিদ মাহিন্থান জোসেফ মারিয়াসিংহাম একটি ভিডিও বার্তায় এই উদ্যোগকে বাংলাদেশের জন্য একটি ‘অগ্রণী পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেন।
বাংলাদেশে বছরে নারী ও পুরুষের গড়ে প্রায় ২,৪৩৫ ঘণ্টা অবৈতনিক গৃহস্থালী ও যত্নমূলক কাজে ব্যয় হয়, যার মধ্যে ৭৯ শতাংশ সময় অবৈতনিক গৃহস্থালী কাজে এবং বাকিটা অবৈতনিক যত্নমূলক কাজে ব্যয় করে থাকে। অবৈতনিক গৃহস্থালী ও যত্নমূলক কাজের মোট সময়ের মধ্যে ৮৮ শতাংশ সময়। (২,১৪৬ ঘণ্টা) নারীরা ব্যয় করে থাকে। এক্ষেত্রে, অবৈতনিক গৃহস্থালী কাজের মধ্যে ৮৯ শতাংশ এবং যত্নমূলক কাজের ৮৬ শতাংশ সময় নারীরা ব্যয় করে থাকে।
লিঙ্গ এবং প্রকারভেদে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে বার্ষিক মোট সময় ব্যয় এবং ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী জনসংখ্যার অবৈতনিক কাজে মোট সময় ব্যয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নারীর অদেখা শ্রমের এই পরিসংখ্যান কেবল একটি সংখ্যার হিসাব নয়। এটি নীতি ও বাজেট প্রণয়নে লিঙ্গ-সংবেদনশীলতা বাড়ানোর জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীর অমূল্য অবদানকে দৃশ্যমান করে এক নতুন দিগন্তে প্রবেশ করল।