
জলবায়ু পরিবর্তন আজ এক বিশ্বব্যাপী সংকট, যা আমাদের অস্তিত্বের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ এবং নদীবহুল দেশের জন্য এই সংকট আরও প্রকট। আমাদের দেশের আবহাওয়ায় আর্দ্রতার পরিমাণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কেবল অস্বস্তিকর নয়, বরং পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। এই ক্রমবর্ধমান আর্দ্রতা নিরসনে এবং সামগ্রিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় একটি সবুজ বিপ্লব এখন সময়ের দাবি। এটি কেবল একটি পরিবেশগত উদ্যোগ নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও টেকসই জীবন নিশ্চিত করার কৌশলগত পদক্ষেপ। এই নীরব বিপদ আমাদের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই, এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের প্রকৃতির কাছেই ফিরে যেতে হবে।
বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে অসহনীয় গরম এবং উচ্চ আর্দ্রতার কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বর্ষাকালে এই আর্দ্রতা আরও বৃদ্ধি পায়, যা নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার জন্ম দেয়। ত্বকের সংক্রমণ, শ্বাসকষ্ট, হিট স্ট্রোকের মতো সমস্যাগুলো এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অতিরিক্ত আর্দ্রতা কৃষি উৎপাদনকেও ব্যাহত করে, কারণ অনেক ফসলই উচ্চ আর্দ্রতায় ভালোভাবে ফলন দিতে পারে না। উপরন্তু, অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতিও বৃদ্ধি পায়, যেমন মরিচা পড়া, কাঠের জিনিস পচে যাওয়া ইত্যাদি। এই আর্দ্রতা বৃদ্ধির মূল কারণগুলির মধ্যে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, এবং নির্বিচারে বৃক্ষনিধন। প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় আমাদের আবহাওয়ামণ্ডল তার স্বাভাবিক আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারাচ্ছে।
জলবায়ু মডেলগুলো নির্দেশ করে যে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়ছে। উষ্ণ বায়ু বেশি জলীয় বাষ্প ধারণ করতে পারে, ফলে আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায়। শহরাঞ্চলে কংক্রিটের কাঠামো এবং যানবাহনের ধোঁয়া তাপ ধরে রাখে, যা ‘আরবান হিট আইল্যান্ড’ প্রভাব সৃষ্টি করে এবং আর্দ্রতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। গ্রামীণ এলাকাতেও বন উজাড়ের কারণে মাটি ও বায়ুর আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে আর্দ্রতা বাড়ছে। এই নীরব বিপদ আমাদের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের প্রকৃতির কাছেই ফিরে যেতে হবে। সবুজ বিপ্লব মানে শুধু বেশি গাছ লাগানো নয়, এর অর্থ হল একটি সামগ্রিক পরিবেশ-বান্ধব জীবনযাত্রা এবং উন্নয়নের ধারা নিশ্চিত করা।
গাছ কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে, যা বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। গাছপালা মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখতেও সাহায্য করে এবং স্থানীয়ভাবে শীতল পরিবেশ তৈরি করে। শহরাঞ্চলে রাস্তার পাশে, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, এমনকি ব্যক্তিগত বাড়ির আঙিনায়ও বৃক্ষরোপণ অভিযান জোরদার করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বনায়ন সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বনায়ন কেবল বায়ুর গুণগত মান উন্নত করে না, বরং জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতেও অত্যাবশ্যক। একটি সুসংগঠিত এবং কার্যকর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, যেখানে সঠিক প্রজাতির গাছ নির্বাচন এবং তাদের নিয়মিত পরিচর্যার উপর জোর দেওয়া হবে, তা দীর্ঘমেয়াদী সুফল দেবে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, যা উষ্ণায়ন এবং আর্দ্রতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ এবং বায়োমাসের মতো নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলির ব্যবহার বৃদ্ধি করে আমরা কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারি। সরকারি প্রণোদনা এবং সহজলভ্যতার মাধ্যমে এই খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা অত্যাবশ্যক। গৃহস্থালি, শিল্প এবং পরিবহন খাতে জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ধাবিত হওয়া জরুরি। এটি কেবল পরিবেশগত সুবিধা দেবে না, বরং জ্বালানি নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে এবং অর্থনৈতিকভাবে দেশকে শক্তিশালী করবে।
রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট করে এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। জৈব সার, শস্য আবর্তন এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মতো পরিবেশ-বান্ধব কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। এটি কেবল মাটির উর্বরতা রক্ষা করবে না, বরং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনও কমাবে। জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন ও প্রচলন করাও গুরুত্বপূর্ণ, যা আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে আধুনিক ও পরিবেশ-বান্ধব কৃষি practices উৎসাহিত করা প্রয়োজন।

নদী, খাল, বিল এবং পুকুর আমাদের পরিবেশের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রক। অপরিকল্পিত দখল এবং দূষণের কারণে অনেক জলাধার আজ বিলুপ্তির পথে। এই জলাধারগুলো সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি। এটি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বজায় রাখতে এবং স্থানীয় আবহাওয়ার আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। নদী ও খাল খনন, জলাভূমি পরিষ্কার করা এবং অবৈধ দখলদারিত্ব থেকে জলাধারগুলোকে মুক্ত করা প্রয়োজন। স্থানীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জলাধারগুলোকে রক্ষা করা সম্ভব, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব মোকাবেলায় একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
সবুজ বিপ্লব তখনই সফল হবে যখন প্রতিটি নাগরিক এর গুরুত্ব উপলব্ধি করবে এবং নিজেদের দায়িত্ব পালন করবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সামাজিক সংগঠনগুলোকে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিবেশ-বান্ধব জীবনযাপন, যেমন কম বিদ্যুৎ ব্যবহার, পানি সংরক্ষণ, বর্জ্য কমানো ও পুনর্ব্যবহার – এই বিষয়গুলো দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং স্থানীয় পর্যায়ের কর্মশালার মাধ্যমে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে পরিবেশ সুরক্ষায় অনুপ্রাণিত করা এবং তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি করা দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের চাবিকাঠি।
একটি সফল সবুজ বিপ্লবের জন্য সরকারের সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য। এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতি, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং কঠোর বাস্তবায়ন। পরিবেশবান্ধব প্রকল্পগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে এবং দূষণকারী শিল্পগুলির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। গ্রিন ফাইনান্সিং বা সবুজ অর্থায়নের সুযোগ তৈরি করে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজ নিজ এলাকায় বৃক্ষরোপণ, জলাধার সংরক্ষণ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার নিয়মিত মূল্যায়নের মাধ্যমে অগ্রগতি নিশ্চিত করা জরুরি।
সবুজ বিপ্লব কেবল সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এটি একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে। নিজের বাড়িতে একটি বাগান করা, বিদ্যুৎ ও পানির অপচয় কমানো, প্লাস্টিকের ব্যবহার সীমিত করা এবং গণপরিবহন ব্যবহার করা – এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলিই সামগ্রিকভাবে একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে। আমাদের সন্তানদের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতার বীজ বুনে দিতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সবুজ ও সুস্থ পৃথিবী গড়ে তুলতে পারে। পরিবেশের প্রতি সহানুভূতিশীল একটি সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমেই আমরা সবুজ বিপ্লবের স্বপ্নকে সার্থক করতে পারব।
জলবায়ুর ক্রমবর্ধমান আর্দ্রতা একটি গুরুতর সমস্যা, যা আমাদের জীবন ও জীবিকার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে এবং একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে সবুজ বিপ্লব আমাদের জন্য একমাত্র পথ। এটি শুধু একটি পরিবেশগত আন্দোলন নয়, এটি একটি সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। আসুন, আমরা সবাই মিলে একটি সবুজ ও সুস্থ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হাতে হাত রেখে কাজ করি। আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই পৃথিবীকে আবারও বাসযোগ্য করে তুলতে, যেখানে আর্দ্রতার অস্বস্তি নয়, সবুজের সতেজতা হবে আমাদের নিত্যসঙ্গী। আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ ভবিষ্যৎ আমাদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল।
ওসমান গনি
লেখক – সাংবাদিক ও কলামিস্ট