নভেম্বর ২৭, ২০২৪

বুধবার ২৭ নভেম্বর, ২০২৪

কুমিল্লায় ৩০০ বছরের ঐতিহাসিক ভৈরব মজুমদারের জমিদার বাড়ি

কুমিল্লায় ৩০০ বছরের ঐতিহাসিক ভৈরব মজুমদারের জমিদার বাড়ি
কুমিল্লায় ৩০০ বছরের ঐতিহাসিক ভৈরব মজুমদারের জমিদার বাড়ি। ছবি: সংগৃহীত

কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজও কুমিল্লায় ৩০০ বছরের পুরানো ভৈরব মজুমদারের জমিদার বাড়িটি। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার জগন্নাথদীঘি ইউনিয়নের বরদৈন ভৈরব মজুমদারের ৩০০ বছরের জমিদার বাড়ি। ওই এলাকার বরদৈন মুন্সী বাড়িতে তৎকালীন জমিদার ভৈরব মজুমদার সুদর্শন বাড়িটি নির্মাণ করেন।

বর্তমানে বাড়িটির সংস্কার না হওয়ায় দিন-দিন তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। বাড়িটির দরজা জানালাগুলো ভেঙে গেলেও সুপ্রাচীন এই দোতলা বাড়িটি কালের রাজ স্বাক্ষী হিসেবে এখনো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভৈরব মজুমদারের পূর্বপুরুষরা ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে ১৬০০ সালে এ দেশে আসেন। মোগল সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর উত্তর প্রদেশের একটি ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন ভৈরব মজুমদারের পিতা রঘু নারায়ণ মজুমদার।

পরে এই অঞ্চলের তিনি একটি বিশাল মৌজার মালিক হয়ে যান। তারই পুত্র ছিলেন ভৈরব মজুমদার। পাশের আরেকটি অঞ্চলের ভাটির বাঘ খ্যাত বর্তমান বৃহত্তর নোয়াখালীর জমিদার শমসের গাজী ১৭৩৯-৪০ সালে ত্রিপুরার মহারাজার খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেয়।

ফলে ওই সময় মহারাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন ত্রিপুরাবাসী। তখন তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন এই অঞ্চলের জমিদার ভৈরব মজুমদার। এক সময় মহারাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করে ত্রিপুরার শাসনকর্তা হয়ে যান শমসের গাজী।
মহারাজার সঙ্গে সেই যুদ্ধে ভৈরব মজুমদার তার নিজস্ব সেনাবাহিনী নিয়ে শমসের গাজীকে সহায়তা করেন। বৃটিশ রাজা পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হলে ত্রিপুরার পরাজিত কৃষ্ণ মানিক্য বৃটিশদের সহযোগিতায় শমসের গাজীকে আক্রমণ করে পরাজিত করেন। বন্দি হন ভৈরব মজুমদার।

সুদর্শন ভৈরব মজুমদারের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে রাণী রাজাকে অনুরোধ করেন তাকে মুক্ত করে দিতে। রাণীর কথা রাখতে গিয়ে কৌশলে রাজা ভৈরব মজুমদারের শরীরে বিষ প্রয়োগ করে মুক্ত করে দেন। ত্রিপুরার উদয়পুর থেকে ঘোড়া দাবড়িয়ে বরদৈন আসলে তার শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়া থেকে পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। একই স্থানে তাকে সমাহিত ও তার সম্মান রক্ষার্থে তার বংশধররা তৎকালীন ১৭৬০ সালে ২টি সুউচ্চ মঠ নির্মাণ করেন। যা আজও বিরাজমান রয়েছে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ভৈরব মজুমদারের বংশধররা এই অঞ্চলের প্রজাদের কল্যাণে অনেক অবদান রেখেছেন।

দেশ বিভাগের আগ থেকেই এই বাড়ির বেশির ভাগ সদস্য ব্যবসা-বাণিজ্য ও উচ্চ শিক্ষার জন্য সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে পাকিস্তান শাসনামলে এই বাড়ির লোকজন কমতে থাকে। ভৈরব মজুমদারের চতুর্থ প্রজন্ম অনাথ বন্ধু মজুমদার কুমিল্লা শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করেন।

বর্তমানে অনাথ বন্ধু মজুমদারের এক পুত্র শক্তি ভূষণ মজুমদার বসবাস করেন নগরীর পুরাতন চৌধুরী পাড়ায়। তার একমাত্র পুত্র ভাস্কর মজুমদার প্রতি বছর পূর্বপুরুষদের স্মৃতি ধন্য বরদৈন মুন্সী বাড়িতে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসেন।

ইতিহাসের পুথি কাব্যে ভৈরব মজুমদারকে নিয়ে লেখা না হলেও লোকমুখে পালা গানে তিনি বেঁচে আছেন এখনো। যেগুলো সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি।
ভৈরব মজুমদারের ষষ্ঠ বংশধর ভাস্কর মজুমদার বাসসকে বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আমাদের বংশধররা ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেখাপড়ার জন্য দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বাড়িটিতে লোকজন বসবাস করে না।

বর্তমান প্রজন্ম জানে না ভৈরব মজুমদারের ইতিহাস সম্পর্কে। তিনি আরও বলেন, যদি বাড়িটি এবং রাজার তৈরি করা তার স্ত্রীর স্মরণে নির্মিত মঠগুলো সরকার সংরক্ষণ করে এমনকি ইতিহাস তুলে ধরে তাহলে আমাদের প্রজন্ম এ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারবে।

এ বিষয়ে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হোসেন বাসসকে বলেন, আমি সরজমিন গিয়ে বাড়িটির বর্তমান অবস্থা দেখবো। সরকারিভাবে বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণ করা যায় কিনা- সে বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবো।